বাঁচার গল্প–ভবঘুরে || ছোটগল্প || অকপট অনুসন্ধান

0

 




                                                 ।।  এক ।।

মেয়েটা অপরাধী।
চোখ ঝলসানো রূপ আর হত দরিদ্র বাপ মা।অপরাধ বৈকি।মহা অপরাধ।জন্মের প্রাক মুহূর্তে অপরাধ ছিল দুটো,যা কিনা ঈশ্বর প্রদত্ত ।তিন নম্বর অপরাধটা সে নিজেই করল।জেনেশুনে ।...
                                            
                                                 ।। দুই ।।
'চশমখোর'
শহরের বিখ্যাত ল ইয়ার তিরিশোর্দ্ধ অবিবাহিত সুবিনয় পাত্র পাবলিকের দেওয়া কুখ্যাত এই খেতাবটা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন । কেউ কেউ তাঁকে চামারও বলে । 'এক পয়সার মা বাপএই কিছুদিন হল পুরোনো হয়েছে ।

'পাত্র উকিলের সঙ্গে কথা বললেই দশ হাজার টাকা ফিস লাগে' কেস হাতে নিলে লাখ টাকার ঘরে ওঠানামা করে।শেয়ার বাজারের সেনসেক্সের মতো।বাকি খরচ মক্কেলের।চেম্বারে বসেন যেন মক্কেলকে দয়া করেন।দ্য রিয়েল জমিনদার।
কারন আছে।ছিপুড়ে তো কত আছে।মাছ বিহীন পচা এঁদো ডোবায় ছিপ নাচিয়ে শিঙিমাগুরশোলল্যাটা,কই মাছ ধরার ক্ষমতা একমাত্র তিনিই রাখেন।এক্কেরে নিশ্চত হারা কেসকেও সুবিনয় ইচ্ছে করলে জেতাতে পারেন।
কানাঘুষায় লোক মুখে কথাটা তাঁর কানেও আসে,  'ব্রিটিশরা চলে যাবার সময় এই এক পিস মাল রেখে গেছে।'বুদ্ধিতে সেয়ানা শেয়ালদেরও কোচিং ক্লাস নেওয়ার যোগ্যতা রাখেন।
                                                                   
                                          ।।  তিন  ।।

সংবাদ পত্রমিডিয়া কদিন ধরে খুব উত্তাল।প্রভাবশালী বিশিষ্ট জননেতার একমাত্র পুত্র জনসমক্ষে নিহত।খুন! তাও একটি মেয়ের হাতে !
হত্যাকারিনী গ্রেপ্তার।পুলিশি তৎপরতা দেখার মতো।নেতার নেক নজরে আসার জন্য হোক আর টেবিলের উপর নীচে নোটের বান্ডিল লেন দেন হবার জন্য হোকতদন্ত অফিসাররা ওই নেতার পদ লেহন বা তাঁর বিশেষ অঙ্গে তৈল মর্দনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল। ফল স্বরূপ ৩০২ ধারা সহ আরো অতিরিক্ত ধারার ধারাবাহিকতায় খুনী মেয়েটি কোর্টে চালান হল।চার্জশিটে প্রত্যক্ষদর্শীদের বুনোট বয়ানে ফাঁসি নিশ্চিত।

ইতিমধ্যেই নিউজ চ্যানেলগুলো পাবলিক এস এম এস চালু করে দিয়েছে।টিআরপি হুহু করে বাড়ছে তাদের।বিজ্ঞাপন দাতারা হুড়োহুড়ি বাধিয়ে দিল ব্রেকিং নিউজের ব্রেকে তাদের কুমিরি আদিখ্যেতা পাবলিককে গেলাতে
                                          ।। চার ।।           

হতদরিদ্র হাড় হাভাতে বাপ মার ঘরে জন্ম দেবার আগে বিধাতা খুব মনোযোগ সহকারে মেয়েটিকে গড়েছিলেন।তিল তিল করে তুলির রূপটানে তিলোত্তমার রূপ সৌন্দর্যে আগুনের শিখার মতো জ্বলে উঠেছিল মেয়েটি।সেই সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাপ মা নাম দিল শিখা।...

এভাবেই চলছিল।কিন্তু ছন্দ পতন ঘটল।
বাপটা একদিন ফট করে মরে গেল।...তবুও জীবন থেমে থাকল না।মা লোকের বাড়ি বাসন মেজে রান্না করে মেয়েটাকে ইসকুলে পাঠালো ।
পড়াশুনায় চৌখসখেলাধূলায় দুর্দান্ত মেধাবী শিখার আগুনে পুড়তে
পুড়তে পুরুষ সমাজ চরিত্র হারাতে হারাতে হায়েনার মতো লালা
ঝরাল।শিখার সেদিকে ভ্রুক্ষেপই নেই।পড়াশুনা শেষ করে একটা
চাকরি জোটাতেই হবে।মাকে বিশ্রাম দেওয়া তার জীবনের একমাত্র ব্রত।
কিন্তু বিধি বাম।
একে গরীবতায় চোখ ধাঁধানো রূপ।দু দুটো অপরাধ!দুটো অপরাধের শাস্তি স্বরূপ শাসক দলের জননেতার বখাটে ছেলের কুনজরে পড়তে  সময় লাগল না।যখন তখন উত্যক্ত করা অথবা কু প্রস্তাব দেওয়া এহেন জঙ্গলের অসাম্য রাজনীতি অসহায় মা মেয়েকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলল।শেষে শিখা স্ব ইচ্ছায় তিন নম্বর
অপরাধটা করেই ফেলল।...
                                          ।। পাঁচ ।।

সুবিনয় পাত্র কদিন ধরে লক্ষ্য করছেন ব্যাপারটা।তাঁর সদর গেটের একপাশে রুগ্ন বৃদ্ধাটি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকেন।ভিখারি মনে করে শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ তিনি করলেন।ড্রাইভারকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে পাঠালেন।ড্রাইভার টাকা সমেত ফিরে আসতে তিনি অবাক হলেন।'ভিখারি নয় ! তাহলে এখানে দাঁড়িয়ে থাকে কেন ?'কেমন যেন চেনা চেনা লাগে তাঁর।
ড্রাইভার জানালো বৃদ্ধা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান।চেম্বারে ঢোকার মতো টাকা তাঁর নেই।তাই এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকেন।

তিনদিন পর সুবিনয় কৌতুহলী হলেন।বাড়ির চেম্বারে বসে লোক দিয়ে ডেকে পাঠালেন বৃদ্ধাকে।বৃদ্ধা এলেন।ফাঁকা সিঁথি আর সাদা থান কাপড় বৃদ্ধার বৈধব্য বুঝিয়ে দেয়।
-- "কী ব্যাপারআপনি নাকি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান ? বলুন কী বলবেন ।"সুবিনয় বসতে বলে জিগ্যেস করলেন ।

বৃদ্ধা ইতি উতি তাকালেন।তারপর বুকের সাথে চেপে ধরা পুঁটলিটা টেবিলে রাখলেন।পুঁটলি খুলে একে একে সব বের করলেন।সুবিনয় দেখলেন ধৈর্য্য সহকারে। চারটে সোনার চুড়িএকজোড়া কানের দুলদশ পঞ্চাশ একশ টাকার কয়েকটা নোট।আর ...আর , একটা ঠাকুরের মুর্তি।কালো কুচকুচে।সম্ভবত কষ্টি পাথরের।

-- " এর বেশি আর কিছু নেই বাবা।" বৃদ্ধা বললেন।
-- " কিন্তু এগুলো আমাকে দিচ্ছেন কেন?" বিস্মিত সুবিনয়। 
-- " কারন আমি চাই আমার মেয়ের হয়ে আপনিই কেস লড়ুন। ফাঁসির আসামিকিন্তু সে মরলে আমাকেও মরতে হবে।আর সব নারী জাতের মরন হবে।"

--  " কী করেছে আপনার মেয়ে? " নিস্পৃহ  সুবিনয়।
--- " খুন ।নেতার লম্পট ছেলেকে। খবরের কাগজ ওলারা সত্যিটা জানতে পারছে না।" অকম্পিত উত্তর বৃদ্ধার।

-- " সত্যিটা কী ?" কৌতুহলী সুবিনয়।

বৃদ্ধা স্থির দৃষ্টিতে তাকালেন তাঁর দিকে। 
তারপর বলতে লাগলেন , "সেদিন ছিল রবিবার।কাজের বাড়ি থেকে ফিরতে আমার দেরি হয়।আমার শিখা ঘরে একলাই ছিল। নেতার ছেলে ঝন্টু সবসময়ই বিরক্ত করেযেখানে সেখানে হাত ধরে টানে বলে বলেছিলুম দরজা ভিতর থেকে বন্ধ রাখতে।তাই ছিল। ঝন্টু সারাদিন বারে বারে দরজা ধাক্কিয়ে ফিরে যায়।আমি রাতে ফিরলে আমার শিখা কাঁপতে কাঁপতে সব বলে।আমিও ভয় পাই। রাত বারোটা নাগাদ খেতে বসি।ঠিক তখনই মদ খেয়ে ঝন্টুরা  দরজা ভেঙে ঢোকে। 
কত কাঁদল মেয়েটাআমি চিত্কার করে সবাইকে ডাকলাম।কেউ এল না বাঁচাতে।দরজায় ঝন্টুর দুই শাগরেদ দাড়িয়ে ছিল যে । "
দম নিলেন বৃদ্ধা।একটানা অনেকক্ষণ কথা বলে হাঁফিয়ে পড়েছেন।
সুবিনয় ঢাকা জলের গ্লাস এগিয়ে দিলেন।এক নিঃশ্বাসে সব জলটুকু খেয়ে নিলেন বৃদ্ধা।
সুবিনয় সময় দিলেন।স্বভাব বিরুদ্ধ কাজ শুরুতেই যখন শুরু করেছেন আজ তখন 'দেখাই যাক কী হয়'মনোভাবে তাকালেন বৃদ্ধার দিকে।মিডিয়ার খবরে তিনিও কদিন ধরে কৌতুহলী ছিলেন।
বৃদ্ধা আবার শুরু করলেন , "আমি পা ধরে কত কাঁদলুম।শিখা চিত্কার করলে।সব জামাকাপড় ছিঁড়ে দিল।আমার শান্ত মেয়েটাকে কত কস্ট দিল।মেঝেতে রাখা বঁটিটা আমি খেয়াল করিনি।করলে আমিই বসিয়ে দিতাম।আমার শিখা যখন বঁটিটা ঝন্টুর গলায় আর পেটে চালালো তখন সবাই ছুটে এল। 
আমাদের যে কিছুই নেই।ওই ইজ্জতটুকু সম্বল।ইজ্জত বাঁচাতে আমাদের বঁটিই ভরসা বাবা।"
বৃদ্ধা থামলেনসুবিনয় নীরব।চেম্বারে পিন পতন নৈশব্দতা।...
                                          ।। ছয় ।।

আবার মিডিয়া উত্তাল হল।মার্ডার কেস নতুন মোড় নিয়েছে। খুনীর পক্ষে সুবিনয় পাত্র সওয়াল করবেন !ভাবা যায় !অবাক দুনিয়া।সূর্য কি রাতে ওঠেঅত বড় উকিলটার কি মাথা খারাপ হল ? এবার নির্ঘাত হারবে।
আবার এস এম এস।আবার তৎপরতা।কৌতুহল।আগ্রহ।ফেসবুক টুইটারে সমালোচনা প্রশংসা কটুক্তির ঝড় ।
                                         ।। সাত ।।

আজ মামলার শেষ দিন।হত না।আগের ডেটে জজসাহেব একতরফা রায় দেবেন এমন সময় হঠাত্ সুবিনয় পাত্র কোর্টে ওকালত নামা জমা দিলেন আসামির হয়ে লড়তে।তাই আজ শুনানির লাস্ট ডেট।
কোর্টে মারাত্মক ভিড়।বাইরে তার চারগুন।পুলিশ হিমসিম খাচ্ছে। পাবলিক এখন দ্বিখন্ডিত।নেতার প্রতি একতরফা দরদ নেই।ঘটনা সবাই জেনে গেছে।মিডিয়াই প্রকাশ করেছে।নারীর ইজ্জত রাস্তায় মিশলে রাস্তার লোকের গায়ে লাগে।প্রতিবাদ করেনা ভয়ে।
আজ সুযোগ এসেছে প্রতিবাদের। 
এখন দেখার বিষয় এটাই যেসুবিনয় পাত্র ব্রিটিশ মগজাস্ত্র ব্যবহার করে কিভাবে এই হারা কেস জেতে ! পারবে কি আসামিকে বাঁচাতে?...
বিচারক টেবিলে হাতুড়ি ঠুকতেই আদালত কক্ষ নীরব হল।পরোক্ষে নেতা নিযুক্ত সরকারি কৌসুলি তাঁর স্বাক্ষী প্রমান সহযোগে দারুন নাটকীয়তায় আসামির ফাঁসির জোরালো আবেদনে বিচারক নড়ে চড়ে বসলেন।অদ্ভুত কাকতালীয় ব্যাপার।বিচারক নিজেই একজন মহিলা !
বিচারপতি সুবিনয় পাত্রের দিকে তাকালেন।সুবিনয় উঠলেন।
বৃদ্ধার মুখে শোনা আর ব্যক্তিগত তদন্তে পাওয়া ঘটনাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করলেন।তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বে শুনলো সবাই । আগে শোনা সত্তেও।
-- " মহামান্য আদালতআমি এটাই বলতে চাই যে একজন অসহায় নারী নিজের ইজ্জত বাঁচাতে প্রান রক্ষার কৌশলে কেউ মারা গেলে সেটা খুন না।দূর্ঘটনা মাত্র ।এই অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুর জন্য আমার মক্কেল দায়ী না।দ্যাটস অল মাই লর্ড।"

-- " কিন্তু মৃত্যু মৃত্যুই।আর সেটার জন্য দায়ী কে সেটাই বিচার্য বিষয়।" সরকারি পি পি বললেন।
সুবিনয় পান খান সবাই জানে।এখন তাঁর হাতে পানের ডিব্বা।
পকেট থেকে পানের ডিব্বা বের করতেই জজসাহেবা হেসে ফেললেন।পিপিও মৃদু হাসলেন।পানের ডিব্বা নিয়ে এগিয়ে গেলেন বিচারপতির দিকে।এ পর্যন্ত ঠিক ছিল।সবাই ভাবলেন পান খাওয়ার আমন্ত্রন। 
কিন্তু না।ডিব্বাটার মুখ খুলে জজসাহেবার টেবিলে উপুড় করতেই বিরাট বড় ভয়য়ংকর দর্শন কাঁকড়া বিছাটি দেখা গেল।হুল উঁচিয়ে তেড়ে গেল বিচারকের দিকে।বিস্মিত ভীত সন্ত্রস্ত বিচারক হাতের কাছে থাকা হাতুড়ি দিয়ে বিছেটাকে থেঁতলে মারলেন।
-- " এ কেমন বেয়াদপি মিস্টার পাত্র!"
---" মাফ করবেন মাই লর্ড।বিছেটা নির্বিষ ছিল।তাছাড়া ওটা কামড়ালে আপনি মরতেনও না।তবু মারলেন।কেন ? কেন মাই লর্ড ? আপনার জীবন জীবনআর এ মেয়েটির জীবন জীবন নয়?! ও যদি অপরাধী হয়তবে আপনি কি অপরাধী নাআপনি নিজের জীবন বাঁচাতে যা এখন করলেন শিখাদেবী সেদিন সেটাই করেছিলেন।দ্যাটস অল।"
                                       ।। আট ।। 
আবার উত্তাল জনসমুদ্র।বিচারক একটু আগে রায় দিয়েছেন। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়েছে জনগন।নারীর ইজ্জত আর এক নারী বাঁচিয়েছেন।বিচারক আসামীকে আসামী বলে মানেন নি।ফাঁসি দূরের কথা।পুরো ঘটনা দূর্ঘটনা আর পরিস্থিতির শিকার হিসেবে শিখাকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। 

                                     ।।  উপসংহার ।।
একটু বেশি বয়সেই বিয়েটা সারলেন সুবিনয় পাত্র। 
গুজবগুলো পাল্টে যাওয়ায় পাবলিক কেমন যেন শ্রদ্ধা করতে শুরু করেছেন তাঁকে।লোকে এখনও সরাসরি তাঁর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পায় না। প্রথমেই কথা বলতে হয় তাঁর পি এর সাথে যার নাম শ্রীমতী শিখা সুবিনয় পাত্র।অতীতের ফাঁসির আসামী থেকে অব্যাহতি পাওয়া এক প্রতিবাদী নারী চরিত্র।তাঁর স্ত্রী।


লেখকঃ ভবঘুরে, কোলকাতা।




লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী

আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।

ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com

লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।

ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top