মিথ পুরানের দর্পনে দক্ষিণ দিনাজপুর-বরুণ মোহরী || নিবন্ধ || অকপট অনুসন্ধান

0



১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৫ই আগস্ট ভারতবর্ষে ইংরেজ রাজত্বের সূর্য অস্তমিত হয়।পরে বাংলা ভাগের সঙ্গে সঙ্গে কয়েক শতাব্দী ধরে পরিচিত দিনাজপুর জেলা দুই ভাগে বিভক্ত হয়| এর পূর্বাংশ দিনাজপুর নামে পূর্ব পাকিস্তানের( বর্তমানে বাংলাদেশে) অন্তর্ভুক্ত হয় এবং পশ্চিমাংশ ভারত রাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলায় পরিণত হয়। নবগঠিত এই জেলার নাম হয় পশ্চিম দিনাজপুর জেলা।১৯৯২ সালের ১লা এপ্রিল পশ্চিম দিনাজপুর জেলাকে পুনরায়  দুই ভাগে ভাগ করা হয়। নামের সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে উত্তর অংশের নাম উত্তর দিনাজপুর এবং দক্ষিণ অংশের নাম দক্ষিণ দিনাজপুর রাখা হয়।

কথিত আছে সতী তার দেহ ত্যাগ করলে, মহাদেব সতীর সেই মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে গোটা পৃথিবী জুড়ে প্রলয় নিত্য শুরু করেন। যার ফলে ব্রম্ভার বানানো এই সুন্দর পৃথিবীতে প্রলয় শুরু হয় ।বাধ্য হয়ে বিষ্ণুর কাছে ব্রম্ভা তার সৃষ্টিকে বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করে, অবস্থা বেগতিক দেখে বিষ্ণু তার সুদর্শন চক্রের দ্বারা সতীর শরীর অনেক গুলি খন্ডে বিভক্ত করেন, এই খন্ডগুলি ভারতের যে স্থানে ছড়িয়ে পড়ে সেই স্থানেই শক্তিপীঠ বা পীঠস্থান গড়ে ওঠে |মনে করা হয় সতীর শরীরের একটি খন্ড পতিরামে এসে পড়ে যা পতিরাম বিদ্যেশ্বরী শক্তি পিঠ নামেই খ্যাত।

দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার নানা কাহিনী মহাভারতের বিরাট রাজার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছেকথিত আছে, এই বিরাট রাজার গোশালা ও রাজপ্রাসাদ ছিল এই অঞ্চলের 'বৈরাট্টা' (হরিরামপুর থানা)এলাকায়পাণ্ডবরা অজ্ঞাতবাসকালে বিরাট রাজার গোশালায় ছদ্মবেশে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন এবং অস্ত্রশস্ত্র এক শমী  বৃক্ষের কোটরে লুকিয়ে রেখেছিলেনসেই প্রাচীন শমী  বৃক্ষটি এখনো রয়েছে রাজার অসংখ্য গরুর জল পানের জন্য খনন করা হয়েছিল আলতাদিঘী মালিয়ান দীঘির মত বিশাল জলাশয়রানি ও রাজ কন্যার স্নানের জন্য ব্যবহৃত হতো নিকটবর্তী হাতি ডোবায় বাঁধানো ঘাটটিকথিত আছে নারায়ণের সুদর্শন চক্রের দ্বারা ছিন্নভিন্ন হয়ে কংস রাজার  দেহ তিন খন্ডে বিভক্ত হয়ে তিন স্থানে পড়েরাজার মুণ্ডটি পড়ে করঞ্জি (কুশমন্ডি থানা)নামক  গ্রামে ওই গ্রামের উঁচু ঢিপি, ভাঙ্গা স্তুপ আরো অজস্র পাথরের টুকরো এখনো কংস রাজার মুন্ডের চিহ্ন বহন করে চলেছে প্রতিবছর মাঘী পূর্ণিমায় এখানে কংসব্রত বা কাসব উৎসব পালিত হয়

পৌরাণিক যুগের রাজা বান এই অঞ্চলের শাসনকর্তা হিসেবে প্রসিদ্ধ লাভ করেছিলেন তার নাম অনুসারে এই রাজ্যের নাম হয় বনরাজ্য, রাজধানী হয় বার নগরএই বানগরই বর্তমান  বাণগড় (গঙ্গারামপুর থানা) নামে পরিচিতএর পাশেই রয়েছে পুনর্ভবা ও ব্রাহ্মণী নদী| এই নদীর তীরে বান রাজার কন্যার ঘর "উষাতিটি" ছিলনারায়ণপুরের (গঙ্গারামপুর থানা )নিকটে একটি বিশাল ঢিপিকে স্থানীয় লোকেরা এখনো "উষাতটি" বলে থাকেন

কথিত আছে যে দ্বারকার রাজা শ্রীকৃষ্ণের নাতি অনিরুদ্ধের প্রতি প্রেম আসক্ত হন বান রাজার কন্যা ঊষারাজা রানির অনুমতি ছাড়াই গোপনে তাঁদের বিবাহ সম্পন্ন হয়বর্তমান শিববাড়ির মিশন পাড়াতে ৪টি স্তম্ভ রয়েছে মনে করা হয় এখানেই ঊষা অনিরুদ্ধের মালাবদল হয়তারপর ঊষাকে নিয়ে একদিন অনিরুদ্ধ পলায়ন করেনযে রাস্তা দিয়ে তারা পলায়ন করেছিলেন, সেই রাস্তা 'উষাহরণ রোড '(কুশুমন্ডি থানা) নামে পরিচিতখবর পেয়ে শ্রীকৃষ্ণ তাকে উদ্ধারের জন্য আসেন এবং উভয়ের মধ্যে ভীষণ যুদ্ধ হয়যুদ্ধে বান অত্যন্ত বীরত্ব  দেখালেও শ্রীকৃষ্ণের নিকট পরাজিত হনশ্রীকৃষ্ণ বানের ১০০০ টি হাতের মধ্যে মাত্র দুটি রেখে বাকি ৯৯৮ হাত কড়সহ দাহ করেন|পুনর্ভবা নদীর তীরে যে স্থানে কর গুলি দাহ করা হয়, সেই স্থানটি বর্তমানে করদহ (তপন থানা)নামে পরিচিতএখানে আঠারো শতকে তৈরি একটি ভগ্ন মন্দির রয়েছে

ইতিহাস খ্যাত বানরাজা তার প্রিয়তমা রানির আদেশে একটি দীঘি খনন করান, এই দীঘিতে পূর্ব পুরুষের আত্মার তৃপ্তি বিধানের জন্য রাজা স্বয়ং দীঘির তীরেই তর্পন করতেন| তাই দীঘিটির নামকরণ হয় তর্পন দীঘি |কালস্রোতের ধারায় তর্পন দীঘিই আজকের বিখ্যাত তপন দীঘি (তপন থানা )

কাল প্রবাহে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা পুরানকেন্দ্রিক বহু ঘটনাবলি বহন করে চলা সত্ত্বেও সংস্কারের অভাবে তা ক্রমেই জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে।প্রাচীন ঐতিহ্যমন্ডিত বানগর সংরক্ষণের অভাবে কৃষিক্ষেত্র  ও পশুচারণ ভূমি হয়ে উঠছে।অন্যদিকে ঊষাতিটি ও করঞ্জি গ্রামের পুরানআশ্রিত  উঁচু ঢিপি গুলো সঠিক ভাবে সংরক্ষণের অভাবে ধুকছে ।সঠিক উদ্যোগে জেলার পুরানকেন্দ্রিক ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করা যেতে পারে।

তথ্যসূত্রঃ 
  1. ধনঞ্জয় রায় -দিনাজপুর জেলার ইতিহাস।
  2. রমেশচন্দ্র মজুমদার -বাংলাদেশের ইতিহাস।
  3. কুঞ্জগোবিন্দ গোস্বামী -Excavation’s at Bangarh, Chapter –V





লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী

আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।

ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com

লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।

ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top