ফিরে পাওয়া-ভবঘুরে || গল্প || অকপট অনুসন্ধান

0

মতাজের সঙ্গে পাঁচদিন আগে খুব ঝগড়া হয়েছে । কথা বন্ধ । দূরে থাকি । মোবাইলে কথা হতো। তাও আবার লুকিয়ে । ওর আব্বা হিন্দি সিনেমার ভিলেন অমরেশ পুরীর দ্বিতীয় সংস্করণ । আম্মি শয়তানের সেক্রেটারি । আর ভাই ! ওটা তো শক্তি কাপুর আর ডিপজলের কম্বাইন্ড মিক্সচার ।স্সালা সয়তানের আউলাদ !
কী আর করি । ক্যান্সারের দাওয়াই আছে। প্রেমের নেই। প্রেম মনে হয় ক্যান্সারের দাদু। হ্যাঁ আমি মমতাজকে ভালোবাসি, ওর সঙ্গে প্রেম করি। কিন্তু গত পাঁচদিন আমাদের কথা বন্ধ। অথচ দোষ ওর। যদিও স্বীকার করেনাই বরাবরের মতো ।আমিও রেগে ছিলাম প্রথম দুদিন। অনেকটা প্রথম কাটা পেঁয়াজের মতো। বেশ ঝাঁঝালো । তারপর কেমন নেতিয়ে গেল । মনখারাপ শুরু হলো। তবুও ফোন করিনি। অভিমানী হৃদয় সবসময় হারতে রাজী হয় না।
চারদিন কাটার পর আজ মনে হল মমতাজ কেন আমায় কল করছে না? তবে কী? তবে কী? নাহ্ তা কীকরে হয় !  
এদিকে দেখা করার উপায় নেই । ওর থেকে অনেক দূরে থাকি । সেটা অন্য কারন, অন্য ইতিহাস ।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে মোবাইল কখন কীভাবে যেন টিপে দিয়েছি । প্রচন্ড আগ্রহ । স্ক্রিনের দিকে চোখ । কিন্তু ফুসস্ । হতচ্ছাড়ি কাস্টমার কেয়ারের মেয়েটা সুর করে জানালো, " দিজ নাম্বার ইজ সুইচড অফ"। কোনো মহিলার সুরেলা কণ্ঠ যে এমন বেসুরো লাগতে পারে তা আমার মতো অবস্থায় না পড়লে কেউ বুঝবে না। 
আবারো দুশ্চিন্তা!  কী হল ! মমতাজের ফোন সুইচড অফ কেন? তবে কী,,,
ধুত্তোর । সারাটা দিন মন খারাপ । 
একা থাকি। সেলফ কুক । দুপুর বেলা ভাত রান্না করতে গিয়ে  পুড়িয়ে ফেললাম । যাক গে । ওই খাবো। ডালে দু তিনবার লবন দিলাম। খেতে বসে টের পেলাম । স্নানের ঘরে ঢুকে মেঝেতে আছাড় খেলাম । কপালের পাশে ফুলে উঠল । আয়নায়  দেখলাম টোপা কুলের মতো ফুলে উঠেছে । 
বিকালে অসহ্য মাথা যন্ত্রণা শুরু হল মমতাজের চিন্তায় । এখন আর রাগ নেই । যেটা আছে সেটা বর্ণনা করা যাবে না । 
সন্ধ্যা নাগাদ মনের মধ্যে একটা হতাশা জন্ম নিলএকটা বৈরাগ্য ভাব ।
কে যেন গেয়েছিল , " সাধের লাউ, বানাইলো মোরে বৈরাগী ।" 
এখন মমতাজকেই আমার লাউ মনে হচ্ছে । আমি মমতাজের জন্য কষ্ট পাচ্ছি । সব কিছুতে অনীহা ঠেকছে। হঠাত মনে হল সম্রাট শাহজাহানের কথা । তিনি কত কষ্ট সহ্য করেছিলেন তাঁর মমতাজের জন্য! হায়রে দুনিয়ার সব মমতাজ রাই কী এমন নিষ্ঠুর হয় !
শাহজাহানের না হয় অনেক টাকা ছিল । তাই বাঈশ বছর ধরে তাজমহলের পিছনে পড়ে ছিল । আমার তো অত টাকা নেই । ' কী করি? ভাবতে ভাবতে নীচে নামলাম । আমার ওয়ার্কশপে এলাম । পাশেই টি স্টল । চা কাকার কাছ থেকে এককাপ চা খেলাম । 
- " চা ভালো হয় নি। খুব বাজে । চিনি কম।" এমন অদ্ভুত ফালতু রাগ দেখিয়ে বুড়ো লোকটার উপর খেঁকিয়ে উঠলাম । বৃদ্ধের বিষন্নতা আমায় ছুঁল না। আমাতে আমি এতটাই চিন্তাগ্রস্থ যে, বৃদ্ধ চায়ের দাম তিন টাকা না নিয়ে ই চলে গেল তা খেয়াল করলাম না বা খেয়াল করতেই চাইলাম না । 
কাজে মন বসছে না । অনেকেই ফোন করছে, স্ক্রিনে দেখে ধরতে ইচ্ছে করছে না । ফেসবুকে খানিক ঘাঁটাঘাঁটি  করলাম। কেমন পানসে লাগছে । 
সমীর আহমেদ বলল," কী হইসে ভাইয়াকারোর কল রিসিভ করছ না যে!"
আমার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে আবার বললে," ভাবির জন্য মন খারাপ?"
আমি এবার তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলাম ।-"কে ভাবি? কার ভাবি? কার কথা বলছিস? কাজ করতে এয়েচিস, কাজ করবি। মাইনে নেওয়ার সময় ঠিক তো বুঝে নিস । নিজের কাজ কর।"

সমীর বলল," যা বাব্বা, কী বললুম ! তুমি রেগে যাচ্ছ ক্যান?" বলে ও একটা সিপিইউ অন করলো ।  "আজ হোক কাল হোক তুমি তো ভাবিকেই শাদি করবে ! " এল ই ডি স্ক্রিনে কারসারের ব্লিংক দেখতে দেখতে বললে  ও ।

সমীর আমার ওয়ার্কশপের নম্বর ওয়ান মেকানিক । আরো চারজন আছে । কিন্তু তারা ওর মতো নির্ভরযোগ্য নয়। 
পাশের কেবিন থেকে শানু বললে, " ভাইয়া, মাদার বোর্ডের বায়োস সেট আপ টা একটু দেখে দেবে? আসুস বোর্ড আর নেওয়া যাবে না।

আমি বললাম,"দিতে পারি,কিন্তু তোকে কথা দিতে হবে ওটা দেখানোর পর হয় তুই মরে যাবি, নাহয় জাহান্নমে যাবি।" 
শানু সুট করে সরে গেল। সমীর এর মধ্যে কখন মোগলাই অর্ডার দিয়ে আনিয়েছে। আমার ফেভারিট ফুড । সঙ্গে কোল্ড ড্রিঙ্কস ।
-- " নাও খাও। আর বলো কী হইসে !"
আমি কী ভেবে ব্যাপারটা বললাম । সমীর চুপচাপ শুনলে, কী একটু ভাবলে, তারপর বললে," তুমি ভাবির বাড়ির ল্যান্ড ফোনে ফোন করো। ঠিক হ্যায় । তুমি নম্বর বলো, আমি করছি আমাকে তো আর কেউ চেনে না। ভাবি ধরলে তুমি কথা বলো।
নিমরাজী আমার কাছ থেকে নম্বর নিয়ে কল করলো সমীর । লাউডস্পিকারে দিয়ে টেবিলে রাখলো। রিং হচ্ছে । 
- " হালুউ,...."
মরেছে । ফোন ধরেছে মমতাজের কালা দাদি । সমীরকে বললাম, " ওর দাদি ।"
বাহাত্তুরে বুড়ি হালু বলেই বলল, " কেডা কতা কও ?"
সমীর খুব চালাক ছেলে । বললে, " দাদি আমি সমীর, একটু ...."
সমীরের কথা শেষ হবার আগেই বৃদ্ধা বললে, " কেডা? কুমীর? কুমীর কতা কয় ক্যামনে?"
সমীর চমকে উঠেছে । তাকে যে কেউ কুমীর বলতে পারে তা তার ধারনায় ছিল না বোধহয় । 
- " না না আমি কুমীর নয়, আমি সমীর বলছি। একটু মমতাজ বু জান কে দিন।"
- " অ্যাঁ, দামি কুমীর ? কী সব্বনেশে কতা !" বুড়ির বাজখাই চিতকারে শানু আর গোবিন্দ বেরিয়ে এয়েচে। 
আমি বললাম, " কেটে দে । ওর দাদী বদ্ধ কালা। ভুলভাল শোনে ।
সমীর কেটে দিয়ে আবার করল । আবার লাউডস্পিকারে । রিং হল। আবার বুড়ি । এবার সমীর বললে," হ্যালো দাদী, আমি,,,"
সমীরের কথা পুরো শেষ হবার আগেই বুড়ি বলল," কে? কালো বাদি! কোন হারামজাদা তুই? আমারে কালা বাদি বলিস? তোর ...."
এবার আমি কেটে দিলাম ফোনটা।
ওয়ার্কশপ থেকে বেরিয়ে এলাম । আমার কেবিন লকড করে । বাকিটা সমীর সামলে নেবে । 
কিছুই ভালো লাগছে না । হাঁটতে হাঁটতে ঝিল পার্কের কাছে এলাম। না এলেই ভালো হতো। জোড়ায় জোড়ায়  কপোত কপোতী দেখে বুকটা  জ্বালা করছে। রাগ আর হতাশা কেমন ব্যোমকাচ্ছে আমায় । পাশেই ফার্মেসি । চেনা দোকান । দুটো ঘুমের ট্যাবলেট নিলাম । রাতে খাবো। না খেলে ঘুম আসবে না ।
চলে এলাম নিজের রুমে । টিভি চালালাম  জী সিনেমায় "থ্রি ইডিয়ট" চলছে। ফেবারিট মুভি। কিন্তু এখন ভালো লাগছে না। 
রিমোটের বোতামে আঙুলের দাপাদাপি । চ্যানেল পাল্টাচ্ছি । খবরের চ্যানেলের কচকচানি আর জিওগ্রাফি চ্যানেলের ধকধকানি আমারে বিরক্ত করছে । অফ করে দিলাম টিভিটা।
খেতে ইচ্ছে করছে না । তবু খেলাম। খেলাম কথাটা না বলে জোর করে গিললাম বলা চলে ।
মশারি টাঙাতে ইচ্ছে করছে না। কী হবে টাঙিয়ে? মশা কামড়াবে? ডেঙ্গু হবে? ম্যালেরিয়াহোক । আমার মতো মানুষের মরা উচিত! দেওয়ালে লটকানো ঢাউস ঘড়িটার দিকে চোখ গেল । এগারোটা চল্লিশ । বেশ রাত হয়েছে । 
পকেট হাতড়ে ঘুমের ওষুধ খুঁজে পেলাম না । তারপর মনে পড়ল যে, ঘরে ঢুকে ট্যাবলেট দুটো  টেবিলে রেখেছিলাম । খুঁজে  নিয়ে হাতে নিলাম । শেষ বারের মতো মমতাজের নাম নিয়ে ওষুধের স্ট্রিপ খুলে একটাকে গলায় চালান করতে যাচ্ছি এমন সময় মৌন মোবাইল টুংটাং শব্দে মুখর হল । আমার মোবাইল বাজলো। 
কী ভেবে ওষুধ না খেয়ে মোবাইল টাই আগে রিসিভ করলাম ।
ওপাশের কন্ঠস্বর আমার সবকিছু এলোমেলো করে দিল । ফোন করেছে মমতাজ । আমার মমতাজ । " হ্যাল্লো, কাল সকাল দশটায় তুমি রেডি থেকো। আমি মেট্রোর সামনে থাকবো। সারাদিন তুমি আর আমি । আর হ্যাঁ,ঝগড়ার জন্য সরি, ফোনে চার্জ ছিল না। এখন আর কল ব্যাক করবা না। আই লাভ ইউ।"
ঘচাং করে ফোনটা কেটে গেল । 
আমাকে কোনো কথা বলার সুযোগ দিল না সে ! হতবাক  আমার আমি কী করবো বুঝতে পারলাম না কয়েক মুহূর্ত । শেষে হাতের ওষুধটা টেবিলে রেখে শুয়ে পড়লাম বিছানায় । মাথায় একটাই কথা ঘুরপাক খাচ্ছে,  'কাল সকাল দশটায় আমি আর মমতাজ! '
কী আশ্চর্য!  মাথার যন্ত্রণা গায়েব ! আমি ঘুমিয়ে পড়লাম ।......

সমাপ্ত 

লেখকঃ ভবঘুরে,  কলকাতা


লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী

আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।

ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com

লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।

ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top