সনাতনী চেতনায় দেবী প্রতীমা-বিশ্বজিৎ দাস || নিবন্ধ || অকপট অনুসন্ধান

0


সময়টা শরৎকাল। শিউলি আর কাশফুলের গন্ধে চারদিক ম-ম করে। ভোরবেলা পদব্রজে বেরোলেই দেখা যায় শিউলি ফুল মাটিতে বিছিয়ে আছে—অবহেলিত নয়, বরং মাটির নির্মল রস টেনে নিচ্ছে। মুহূর্তেই আঁচ করা যায় দুর্গাপুজোর শুভক্ষণ দ্বারপ্রান্তে। যে মাটির সুবাস সব শ্রেণির মানুষকে মুগ্ধ করে, সেই মাটিতেই গড়া হবে মায়ের মূর্তি। একে একে মূর্তি গড়া শেষ হলে রং-তুলিতে অঙ্কিত হবে মায়ের শ্রীমুখ; পাশাপাশি দেবী-পরিবারের অন্য সদস্যদেরও নান্দনিক তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা হবে। প্রতি বছরই এই প্রক্রিয়া চলে। তবে সকলেই যে কেবল মাটির মূর্তি নির্মাণেই সীমাবদ্ধ থাকেন, তা নয়—সময় ও রুচির বিবর্তনে নানা রূপে, নানা মাধ্যমে মাকে উপস্থাপন করা হয়ে থাকে।

পূজোর আয়োজন ঘিরে কারুকাজখচিত প্যান্ডেল উঠবে, থিমে থিমে সাজবে শহর-গ্রাম। নবগঠিত সুউচ্চ প্রাসাদসদৃশ প্যান্ডেলে মাকে নিরাপদে সজ্জিত করে রাখা হবে পাঁচটি প্রধান দিন—ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত। এই ক’দিনে ঘটবে অনেক কিছু: আশা, আনন্দ, প্রেম, খুনসুটি—আর কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত দুঃখও। তবু পরিবার-পরিজন মিলে এই কয়েকটি দিনই সবচেয়ে উজ্জ্বল। বিশ্বাসরূপে মা স্বামীর গৃহ থেকে পিত্রালয়ে আসেন—সবাইকে খুশি করতে।

উৎসের খোঁজ: ইতিহাসে শূন্যতা, পুরাণে আলোকরেখাঃ

বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানে দুর্গাপুজোর একটি নির্ভুল কালক্রমিক ইতিহাস আজও নির্ধারিত নয়। নির্ভরযোগ্য দলিলপত্রে স্পষ্ট সূচনাবিন্দু মেলে না; ইতিহাসবিদদের মধ্যেও মতভেদ আছে। তবে পুরাণ, রামায়ণ-মহাভারত এবং শাক্ত-সাহিত্যের নানা পাঠ থেকে কিছু প্রাচীন প্রেক্ষাপট ও আচারগত বিবরণ আমরা পাই।

হিউয়েন সাং-এর কাহিনিঃ

তাং যুগের ভিক্ষু হিউয়েন সাং (Xuanzang) সাত শতকে ভারতে এলেন বৌদ্ধ শাস্ত্র সংগ্রহ করতে। তাঁর ভ্রমণকথায় গঙ্গার পথে ডাকাতদের হাতে পড়ে মানববলির জন্য তুলে দেওয়ার প্রস্তুতির একটি পর্ব উল্লেখ আছে; আকস্মিক ঝড়ে পরিস্থিতি পাল্টে যায় এবং তিনি প্রাণে রক্ষা পান—এই কাহিনি শাক্ত আচারসম্পর্কিত জনশ্রুতির সঙ্গে জুড়ে দেখা হয়।

মাতৃ-দেবীর প্রাচীনতাঃ

ভারতীয় সভ্যতায় দেবী-সংস্কৃতির ধারা অতি প্রাচীন। দ্রাবিড় ও আর্য—বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রবাহে মাতৃত্ব, শক্তি ও প্রকৃতির প্রতীকরূপে দেবী পুজিত। প্রাগৈতিহাসিক নারীমূর্তির মৃৎমূর্তি থেকে শুরু করে শাক্ত তন্ত্র-সাহিত্যে দেবী-চেতনা ধারাবাহিকভাবে বিবর্তিত হয়েছে।

পুরাণ-উপাখ্যান ও শাস্ত্রঃ

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ, ভাগবত পুরাণ, কালিকা পুরাণ ইত্যাদিতে দেবীর আরাধনার নানা আখ্যান ছড়িয়ে আছে। তবে দুর্গা-উপাসনার সবচেয়ে সুবিন্যস্ত বর্ণনা মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর দেবী মাহাত্ম্য অংশে (বাংলায় প্রচলিত নাম শ্রীশ্রী চণ্ডী)। সাতশত শ্লোকে ত্রয়োদশ অধ্যায়জুড়ে দেবীর লীলাকথা ও দর্শন গাঁথা।

দেবী মাহাত্ম্যের তিনটি প্রধান কাহিনি—

  • মধু-কৈটভ বধ: প্রলয়ের জলে বিশ্রান্ত বিষ্ণুকে জাগিয়ে দুই অসুরকে বধের কাহিনি।

  • মহিষাসুর মর্দিনী: দেবতাদের তেজে সৃজিত দেবী কাত্যায়নী/দুর্গার হাতে মহিষাসুর-বধের মহাকাব্যিক পর্ব।

  • শুম্ভ-নিশুম্ভ বধ: দেবী কৌশিকী, চামুণ্ডা ও সপত্নীগণের সহায়তায় অসুরবধের সমাপন।

আরো রয়েছে রাজা সুরথবৈশ্য সমাধির তপস্যার কাহিনি—দেবীপ্রসাদে রাজ্যপ্রাপ্তি ও তত্ত্বজ্ঞানলাভের আদর্শ উদাহরণ।

অকালবোধন ও রামায়ণঃ

বাল্মীকি রামায়ণে দেবী-দুর্গার শরৎকালীন পূজার সরাসরি উল্লেখ নেই। কিন্তু কৃত্তিবাসী রামায়ণে ‘অকালবোধন’ কিংবদন্তিতে রাম শরৎকালে দেবীপূজা করে রাবণবধের আশীর্বাদ লাভ করেন—বাঙালি পূজার সংস্কৃতিতে এই কাহিনি অত্যন্ত জনপ্রিয়।

মধ্যযুগ থেকে আধুনিক: মন্দির, রাজপুরুষ ও বারোয়ারিঃ

ঢাকার ঢাকেশ্বরী মন্দিরে দেবী-আরাধনার ধারাবাহিকতা রয়েছে—স্থাপত্যে মধ্যযুগীয় বিন্যাস ও সংস্কারের ছাপ দেখা যায়। বাংলায় প্রাচীনকাল থেকে রাজ-জমিদারদের বাড়িতে দুর্গাপুজোর আয়োজনের কথা শোনা যায়। জনশ্রুতি মতে—

  • কলকাতার বরিশায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের পূজা (১৬১০) আজও প্রাচীন পারিবারিক পূজার ধারাবাহিকতার প্রতিনিধিত্ব করে।

  • প্লাসির (১৭৫৭) পরে শোভাবাজার রাজবাড়িতে রাজা নবকৃষ্ণ দেব-এর আয়োজিত পূজা ব্রিটিশ শাসক মহলের অংশগ্রহণে আলোচিত হয়ে ওঠে।

  • হুগলির গুপ্টিপাড়ায় আঠারো শতকের শেষভাগে বারো জন বন্ধুর উদ্যোগে যে ‘বারোয়ারি’ বা ‘সার্বজনীন’ পূজার সূচনা—তা পরবর্তীকালে বাংলায় কমিউনিটি পূজার প্রধান ধারা হয়ে উঠে।

নেপালে দশাইঁ (Dashain) নামেই দেবী-আরাধনার বৃহৎ উৎসব পালিত হয়—শারদীয়া দুর্গোৎসবের এক অনন্য রূপ।

আধুনিক কালে কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, বিহার, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, দিল্লি, মুম্বই থেকে শুরু করে বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট, রাজশাহী—সবখানেই নানা আঙ্গিকে এই উৎসব উদযাপিত হয়। প্রবাসে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি—সবখানেই দুর্গোৎসব এখন বৃহৎ সাংস্কৃতিক বন্ধনের মাধ্যম; এমনকি ২০০৬ সালে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের গ্রেট কোর্টেও শারদীয়া পূজার আয়োজন হয়েছিল।

আচার-অনুষ্ঠানের ধারাঃ

সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়। মহালয়ার মাধ্যমে দেবীপক্ষের সূচনা—ভোরের পিতৃতর্পণ আর চণ্ডীপাঠে ‘জাগো দুর্গা’ ডাক। মূলত ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী আর দশমী—এই পাঁচ দিন পূজার সবচেয়ে বর্ণিল পর্ব। বসন্তকালের দুর্গাপুজোকে বলা হয় বাসন্তী পূজা; শরতের পূজা ‘অকালবোধন’ নামেও পরিচিত।

নবপত্রিকা বা ‘কলা বউ’ঃ

বাঙালি শাক্তাচারে নবপত্রিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—ন’টি উদ্ভিদ একত্রে দেবীর নবরূপের প্রতীক হিসেবে পূজিত হয়। সাধারণত এগুলো হলো: কলা (সপত্র গাছ), কচু (কলোকাসিয়া), হলুদ, জয়ন্তী, বিল্ব, দাড়িম/ডালিম, অশোক, মান (একপ্রকার লতা/শাক), এবং ধান। সাদা লালপাড় শাড়ি জড়িয়ে ‘কলা বউ’-রূপে প্রতিমার ডানদিকে স্থাপন করা হয়। বিভিন্ন শাস্ত্রে নবরূপের দেবী-সম্বন্ধ ভিন্ন ভিন্নভাবে বর্ণিত; প্রায়শঃ ব্রাহ্মাণী, কালী, উমা/দুর্গা, কার্ত্তিকী, শিবা, রক্তদন্তিকা, শোকরহিতা, চামুণ্ডা ও লক্ষ্মীর সঙ্গে এই উদ্ভিদগুলোর প্রতীকী সম্বন্ধ স্থাপিত হয়।

মন্ত্র ও প্রার্থনাঃ

দুর্গাপুজোর প্রধান মন্ত্রগুলি শ্রীশ্রী চণ্ডী থেকে প্রচলিত। উপাসনার সময় বহুল উচ্চারিত দুটি স্তব—

জয়ন্তী মঙ্গলা কালী, ভদ্রকালী কপালিনী;
দুর্গা শিবা ক্ষমাধাত্রী, স্বাহা স্বধা নমোস্তুতে।

সর্বমঙ্গল মঙ্গল্যে, শিবে সর্বার্থসাধিকে;
শরণ্যে ত্র্যম্বকে গৌরী, নারায়ণী নমোস্তুতে।

অসুরনাশিনী মহামায়া জগদ্ধাত্রী—যে নামেই তিনি স্মরণীয়, অন্তরনমিত ডাকেই সাড়া দেন—রক্ষা করেন শক্তিরূপে, মাতৃরূপে আশীর্বাদ দেন সকলকে।

উপসংহারঃ

দুর্গাপুজো ইতিহাস, মিথ ও আচার—সব কিছুর সম্মিলিত অভিব্যক্তি। কোথাও কোথাও তথ্যের ভিন্নতা, জনশ্রুতি আর শাস্ত্রীয় পাঠের পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও উৎসবটির কেন্দ্রবিন্দু একটাই—অশুভের দমন ও শুভের জয়। শরতের এই কয়েকটি দিন তাই বাঙালির জীবনে কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, সংস্কৃতি ও আত্মপরিচয়েরও উজ্জ্বল উৎসব।

সূত্র: উইকপিডিয়া ও দুর্গাপুজোর ইতিহাস: শ্বাশত স্বপন


লেখকঃ বিশ্বজিৎ দাস (সাতক্ষীরা, বাংলাদেশ)

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top