শারদ শুভেচ্ছা: নীল আকাশ, ধূপের সুবাস ও বাঙালির অনন্ত উচ্ছ্বাস- সৌমেন দাস || প্রবন্ধ || অকপট অনুসন্ধান

0

 শারদ শুভেচ্ছা: নীল আকাশ, ধূপের সুবাস ও বাঙালির অনন্ত উচ্ছ্বাস- সৌমেন দাস



দীর্ঘ বর্ষণমুখর দিনের পর যখন আকাশে প্রথম একটু নীল রঙের ঝলক দেখা দেয়, তখনই মনে পড়ে যায়—শরৎ এসেছে। সাদা তুলোর মতো কাশফুল দোল খেতে খেতে জানিয়ে দেয়, মা আবার ফিরছেন আমাদের বাড়িতে। সেই আকাশভরা নীল, সাদা মেঘের টানা টানা রেখা আর সকালের হিমেল বাতাস যেন আমাদের হৃদয়ের সমস্ত ক্লান্তি মুছে দিয়ে উৎসবের আবেশে ডুবিয়ে দেয়। বাঙালির সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়—এ একটি অনুভূতি, একটি স্মৃতি, একটি সার্বজনীন মিলনের মুহূর্ত।

বর্ষার পর টানা ভেজা দিনগুলো পেরিয়ে যখন শরতে রোদ একটু উঁকি দেয়, তখনই পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেলের কাজ যেন নতুন প্রাণ পায়। বাঁশ, বেত, কাপড়, আলো—সবকিছু মিলিয়ে শিল্পীদের অনবদ্য সৃষ্টিকর্ম প্রস্তুত হয় ধীরে ধীরে। এই সৃষ্টির মধ্যেই লুকিয়ে থাকে হাজার মানুষের স্বপ্ন, পরিশ্রম আর অপেক্ষার গল্প।

মায়ের আগমনের প্রস্তুতি

প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে এখন ব্যস্ততার চূড়ান্ত। কেউ রঙ করছে, কেউ আলো লাগাচ্ছে, কেউ আবার অস্থায়ী মঞ্চে দেবীর মূর্তি স্থাপনের জায়গা প্রস্তুত করছে। ঢাকিদের আগমনে প্যান্ডেলের চারপাশে যেন আরও একটু উৎসবের টান পড়ে। তাদের ঢাকের তালে তালে বাতাসই যেন কেঁপে ওঠে।
এ যেন এমন একটি সময়, যখন প্রতিটি মানুষ নতুন করে বাঁচার শক্তি পায়। আনন্দের চারটি দিন সামনে অপেক্ষা করছে—যেখানে ভক্তি, উচ্ছ্বাস, মিলন আর আবেগ সব একসাথে মিশে যায়।

যেন অপেক্ষার পালা আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার। তারপরেই বেজে উঠবে মায়ের আগমনের মঙ্গলধ্বনি—ঘণ্টা, শঙ্খ আর ঢাকের সুর। ভেসে আসবে ধূপের পোড়া সুগন্ধ, গন্ধরাজ ফুলের মিঠে সুবাস, আর চন্দন-ধূপ-ধুনোর অদ্ভুত এক পবিত্র ঘ্রাণ। মনে হবে—এ জগতের সব অশান্তি, ক্লান্তি, দুঃখ যেন কিছুক্ষণের জন্য মিলিয়ে গেছে।

নবপত্রিকার স্নান: পবিত্রতার সূচনা

পূজোর শুরু হয় নবমির স্নান দিয়ে। আসলে এই নবপত্রিকা স্নান শাস্ত্রীয় নিয়মে দেবীর প্রাক-আগমন সূচক। ভোরের আলোয় নদীর ধারে বা পুকুরে নবপত্রিকার স্নান দেখতে যে মনোরম লাগে, তার তুলনা নেই। ঢাকের বাজনা, মন্ত্রোচ্চারণ আর পানির ঠাণ্ডা ছোঁয়া—সব মিলিয়ে এমন একটি আধ্যাত্মিক আবহ তৈরি হয়, যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।

এই সব আয়োজন, অপেক্ষা, ঘাম, শ্রম—সবই যেন কয়েকটি সংকীর্ণ দিনের জন্য। কিন্তু এই চারটি দিনই বাঙালির প্রাণ।
শুরু হয় ষষ্ঠী, আর চোখের পলকেই দশমীর বিদায়বেলায় বাজতে থাকে বিষাদের সুর।
বছরের সেরা দিনগুলো শেষ হয়ে আসে। মন ভারী হয়ে ওঠে। আবার ফিরে আসার প্রতীক্ষায় সবাই অপেক্ষা করে ৩৫৬ দিনের।

বিজয়ার বিষাদ ও নতুন আশার সূচনা

দশমীর দিন সিঁদুর খেলার মধুরতা যেমন আছে, তেমনি আছে মায়ের বিদায়ের তীব্র বিষাদ।
"মা, আবার আসবে তো!" —এই কথাটা যেন প্রতিটি ভক্তের মনে অনুরণিত হয়।
কিন্তু এই বিদায়ের মধ্যেই রয়েছে ফিরে আসার আশ্বাস। আবার নতুন করে ১২ মাসের প্রস্তুতি শুরু হয়, আবার নতুন করে জন্ম নেয় প্রত্যাশা।

উৎসবের সার্বজনীনতা

আমাদের জীবনের প্রতিটি বিষয়ই আপেক্ষিক। আনন্দ এসেছে, আবার যাবে। ক্লান্তি এসেছে, তাও কেটে যাবে। কিন্তু এই কয়েকটি দিনের মিলনমেলা, এই আনন্দের মুক্ত ছোঁয়া জীবনের সব একঘেয়েমি ভেঙে দেয়।
তাই আসুন, এই কয়েকটি সংকীর্ণ দিন আমরা সকলে সকলের সাথে ভাগ করে নিই—বন্ধু, পরিবার, প্রতিবেশী, সমাজের প্রত্যেক মানুষের সাথে। উৎসব মানে শুধু সাজগোজ, নতুন জামা নয়—উৎসব মানে ভাগ করে নেওয়া, একসাথে থাকার উষ্ণতা অনুভব করা।

অভিভাবকদের প্রতি শ্রদ্ধা, ছোটদের প্রতি ভালোবাসা

পুজোর এই চার দিন হোক বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর মুহূর্ত। তাঁদের আশীর্বাদেই আমাদের পথ আরও শক্তিশালী হয়।
আর ছোটদের দিকে বাড়িয়ে দিন সমস্ত ভালোবাসা। তাদের হাতে তুলে দিন উৎসবের রঙ, আনন্দের স্বাধীনতা।

এই মিলনেই উৎসবের আসল পূর্ণতা।

পুজোর আনন্দে নিজের মতো করে বাঁচুন

চারটি দিন যেন চারটি ঘণ্টার মতো দ্রুত কেটে যায়। তাই প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করুন মন খুলে।
প্যান্ডেল হপিং করুন, বেলুন কিনে ছোটদের হাতে দিন, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিন, আর কব্জি ডুবিয়ে খান—ফুচকা, বিরিয়ানি, চাউমিন, কাটলেট, পায়েস—যা মন চায়।
তবে সুস্থ থাকাটাও জরুরি—পরিষ্কার খাবার খান, পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন, আর নিজেকে হালকা রাখুন।

শেষকথা

শারদ উৎসব শুধু একটা ধর্মীয় আয়োজনে সীমাবদ্ধ নয়। এটি আবেগ, এটি ঐতিহ্য, এটি পরিবারকে একসাথে বেঁধে রাখার এক অভিনব সূত্র। তাই আসুন, মনকে ভরে তুলি আনন্দের আলোয়, সৌন্দর্যের রত্নে, আর ভালোবাসার উষ্ণতায়।

সকলকে আমার আন্তরিক শারদ শুভেচ্ছা ও শুভকামনা।
সুস্থ থাকুন, ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন।


লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী

আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।

ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com

লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।

ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top