রহস্য উদ্ঘাটন -কোয়েল দাস || গল্প || অকপট অনুসন্ধান

0


ধ্যাহ্নভোজ সেরে পেপারে মুখ গুঁজে ঘুমিয়ে যাওয়াটা অবসরের পর থেকেই অমিতাভবাবুর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে কিন্তু আজ তাঁর নাতি সে অভ্যাস পালনে বাদ সেধেছেআবদার দাদুর কাছ থেকে গোয়েন্দা গল্প শুনবে

ইচ্ছা না থাকলেও উপায় নেইগোয়েন্দা বিভাগের প্রাক্তনকর্মী হওয়ায় গল্পের অভাব নেই অমিতাভবাবুর ভান্ডারে

অবসরগ্রহণ আর সাথে বয়সের ভার এখন আর তদন্ত-টদন্তে না যেতে পারলেও গোয়েন্দামনটা এখনও খবরের কাগজ খুললেইস্বতঃস্ফূর্তভাবে রহস্যজনক ঘটনা কোথায় কি আছে সে খোঁজেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে

 

অতি আদরের নাতিকে কোলে বসিয়ে তার কপালে দুবার চুম্বন করে বলতে শুরু করলেন অমিতাভবাবু- "জানিস দাদুভাই সে এক বৃষ্টি ভেজা সকাল মনোজআমিরবিনদা  তুলি নামে অতি সাহসী দুর্ধর্ষ এক মহিলা  

মিলে একটা অত্যন্ত জরুরী বিষয়ে আলোচনায় ব্যস্ত 

হঠাৎই কালো রেনকোট পরে একজন ভদ্রলোক হন্ততন্ত হয়ে  ঘরে ঢুকে এলেন ক্ষনিকের মধ্যেই বিচলিত হয়ে বাইরে গিয়ে বর্ষাতি খুলে রেখে এসে কিছুটা ইতস্ততঃ ভাবে হাতজোড় করে নমস্কার করে ভেতরে প্রবেশ করলেন

প্রায় হাঁফাতে হাঁফাতে বেশ উত্তেজিত হয়েই বললেন-  "আমি নীলাদ্রি 

সেনগুপ্ত আমি বেশ কদিন ধরে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছিআপনারা যেভাবে নারী পাচারকান্ডের চক্রটা সবার সামনে আনলেনতাই সমস্যায় পড়ে আপনাদের কথাটাই মাথায় এলো...

মধ্যপঞ্চাশের ভদ্রলোকটি পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখ মুছতে শুরু করলেনবৃষ্টির দিনেও এরকমভাবে ঘামতে দেখে এক গ্লাস জল এনে রবিনদা বললেন- "নিন জলটা খানশান্ত হোন তারপর কথা হবে.... বলে ফ্যানটা আস্তে করে চালিয়ে দিলেন

জলটা প্রায় এক নিঃশ্বাসে শেষ করে পেছনে দৃষ্টিনিক্ষেপ করে বললেন- “কেন জানি না বেশ কদিন ধরে বোরখা পরা একজন আমাকে সমানে ফলো করছে এই কেন-এর উত্তর খুঁজতে আপনাদের কাছে আসাদয়া করে আমায় সাহায্য করুনআমি বেশ মানসিক চাপের মধ্যে আছি"

 

আমরাও ওনার সমস্যা শোনার জন্য অপেক্ষাতেই ছিলামমনোজদা বললেন- "কি সমস্যা খুলে বলুনদেখি আমরা কতোটা আপনার সাহায্যে আসতে পারি"

নীলাদ্রিবাবু বলতে শুরু করলেন- “আমার কুড়ি-পঁচিশ বছর ধরে কলকাতায় বসবাস ওখানেই কর্মসংস্থান এবং ওখানেই সংসার বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের বাড়ির বহুদিনের বিশ্বস্ত  কাজের লোক দেবুকে এই মর্মে পাওয়ার অফ এটর্নী  দিয়ে যাই যে আমি যতদিন এই গ্রামে থাকবো না সে ততদিন বাড়িজমি-জায়গা সবকিছু দেখাশোনা করবে সেইমত সে এতদিন তার দায়িত্ব সে ঠিকঠাকই পালন করেছে তবে এইকাজের জন্য নিয়মিতভাবে আমি তাকে প্রতিমাসে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি

কদিন আগে আমার কলকাতার বাড়িতে সকালে দরজা খুলতে গিয়ে দেখি একটা খাম পড়ে আছেখুলে দেখি তাতে লেখা-"যত দ্রুত সম্ভব গ্রামের বাড়িতে আসুন না হলে..."

একটু থেমে গিয়ে...... কিছুক্ষণ পর বললেন- "নৃশংসভাবে হত্যা করা হবে দেবুকেদেবুর প্রাণ সংকট জেনে একমুহূর্তও সময় নষ্ট না করে গ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরি এখানে এসে আমার ছেলেবেলার বন্ধু অনুপমের থেকে জানতে পারিদেবুকে শ্বাসরোধ করে খুন করা হয়েছে"

তিনি বুকে হাত রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন- "দেবুকে আমার ছেলের থেকে কোনো অংশে কম দেখিনিদেবু তুই যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস"

 

দেবুর এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুর জন্য অনুপম বারবার আমাকেই দায়ী করছেবলছে- "ওই বয়সের একটা লোককে তোর অতবড় বাড়িতে একা রেখে যাওয়াটা তোর উচিত হয় নি"

গ্রামের ছোটবেলার বন্ধু হিসাবে আমি অনুপমকে খুবই বিশ্বাস করি আর ওর উপর ভরসাও করিতাই তো এবার গ্রামে এসে ওর বাড়িতেই উঠেছি কিন্তু দেবুর এভাবে চলে যাওয়াটা আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না......” এই বলে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন

 

পরের দিন সকালে নীলাদ্রিবাবুকে সাথে নিয়ে অনুপমবাবুর বাড়িতে হাজির হলাম পরিচয় পর্ব শেষে ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম-

"অনুপম বাবু আপনি কি করেন?"

-"এই চাষবাস করি বাবু?"

-"আপনার দেবুর সাথে কতদিন পরপর দেখা হতো?"

 উনি এক কথায় উত্তর দিলেন- "দেখাই হতো না!"

এরপর নানান কথাবার্তা হতে হতে সময় গড়িয়ে গেলো অনেকটাদুপুরের খাওয়াদাওয়া সেরে আমি আর মনোজ নীলাদ্রিবাবুর পৈতৃক বাড়িটা দেখতে গেলাম রাস্তায় দুই জনের মধ্যে বেশ কিছু আলোচনাও সেরে নিলাম

ফিরে দেখি অনুপম বাবু পেপারে মুখ গুজেছেন আর রাঁধুনি যেখানে রান্না করছে সেখানে মনোজের সাথে তার কি নিয়ে কে জানে বেশ ঝামেলা চলছে

এগিয়ে গেলাম সেদিকেএকটু ভয় দেখাতে রাঁধুনি রত্নমালা আমাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলোতাকে বলে দেওয়া হল কেউ যাতে কিছু জানতে না পারে মনোজও আমার দিকে তাকিয়ে নীরবতার ইঙ্গিত দিল

 

তারপর রাত্রে বেশ জমিয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে বিছানায় চলে গেলাম 

মাঝরাতে ঘুম ভাঙলো একটা বিকট শব্দে!

টর্চটা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসতেই অচকিতেই আমার মুখের সামনে দিয়ে বিদ্যুৎবেগে কে একজন ছুটে চলে গেল

টর্চের আলো ফেলতেই দেখি মাটিতে রক্তের ছাপআমিও এদিক-ওদিক খানিক দেখে লোকটা যেদিকে গেল সেদিকে ধাওয়া করলাম খানিকটা দৌড়ানোর পরই চাঁদের আলোয় দেখলাম বোরখা পরা একজন পা টেনে-টেনে হাঁটছে দ্রুত তার কাছে পৌঁছে তার হাতটা জোর করে হাতে চেপে ধরতেই সে ঝটকা দিয়ে পালাতে চেষ্টা করা মাত্রই তার হাতের আংটিটা স্লিপ করে আমার হাতে চলে এলো

আমিও পিছু ছাড়লাম না নিশানা বরাবর এগিয়ে গেলাম সেই বোরখাধারী নীলাদ্রিবাবুর বাড়িতে ঢুকে গেলো

তারপর যা দেখলাম আমার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল আর কোন সন্দেহ রইল না

 

তার পরেরদিন খুব সকালে লোকাল থানার ওসি পুরো ফোর্স নিয়ে হাজির হলেনডেকে পাঠানো হলো নীলাদ্রিবাবু  অনুপমবাবুকে

অনুপম বাবু আপনি বলবেন না আমি বলবোগরিব চাষি থেকে বড়লোক হওয়ার গল্প” এই বলে থেমে গেলেন  রবিনদা তিনি দাদার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেলেন

তুলি বলতে শুরু করল- “অনুপমাবাবুর বহুদিনের লোভ গ্রামে এক ধারে পড়ে থাকা নীলাদ্রিবাবুদের ওই বিশালকার বাড়িটার উপর আশেপাশে বাড়ি না থাকায় আর দেবুর বয়সের সুযোগ নিয়ে ধীরেধীরে বাড়িটার নিচে সুড়ঙ্গ তৈরি করলেনআর জমিয়ে চালাতে লাগলেন বেআইনি অস্ত্রের কারবার হ্যাঁআপনার ছায়াসঙ্গী সুমনের কাছ থেকে এই ঘটনা জানতে পারিসে এখান জেলবন্দি  বেআইনি অস্ত্রের উপর সুমনের আঙুলের ছাপই তার প্রমাণ

হঠাৎ একদিন বৃদ্ধ দেবু দেখে ফেলে সব আর অনুপম কি করবে ভেবে না পেয়ে বৃদ্ধ দেবুকে গলাটিপে ধরেন আর শ্বাসরোধ করে খুন করে বসেন

 

এবার তুলি অনুপামবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল-“ তার কিছুদিন পর কলকাতায় মাল আনতে যাওয়ার নামে নীলাদ্রি বাবুর দরজার ফাঁকে চিঠি দিয়ে আসেন"

 

মনোজ বললো- "আপনি সেদিন লক্ষ্য না করলেও নীলাদ্রীবাবুর পাশের বাড়ির লোক আপনাকে চিঠিটা দরজার ফাঁকে ঢোকাতে দেখেছিল

নীলাদ্রিবাবুকে  বোরখা পড়ে ভয় দেখিয়ে দেখিয়ে তাঁকে মানসিক রোগী প্রমাণ করে তার কাছ থেকে সম্পত্তি হাতানোর মতলব ছিল আপনার"

 

আমি বললাম- " আপনার বাড়িতে আমাদের দেখে আপনি পরিকল্পনা পাল্টে ফেললেন কাল রাতে আমাদের খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে আমাদের ঘুম পাড়িয়ে রাখার পরিকল্পনাও করলেন কিন্তু রাঁধুনিকে হাতেনাতে ধরে ফেলি তাই শেষ রক্ষা হয়নি ভেবেছিলেন সই করিয়ে নিয়ে খুন করে দেবেন নীলাদ্রিবাবুকে কিন্তু রাতে বোরখা পড়ে হাতের ছুরি নিয়ে আমার সাথে দেখা হয় ডান হাত ধরতেই খুলে যায় আপনার আংটিটামানে ওই পান্না বসানো আংটিটা যেটা দুপুরবেলায় আপনি হাতে পড়েছিলেন,  এখন সেটা আমার হাতে"

 

অনুপমবাবু সুযোগ বুঝে পালানোর চেষ্টা করলেন... কিন্তু কোন লাভ হল নাপুলিশের হাত থেকে পালাতে পারলেন না তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন

 

নীলাদ্রিবাবু হাত দুটো জড়ো করে বললঅসংখ্য ধন্যবাদ আমায় চিন্তামুক্ত করলেন আপনারা

 

ভারী হয়ে যাওয়া পরিবেশটাকে হালকা করতে তুলি বিশ্বাস হাতটা আমার কাঁধে রাখল সেই দিনের বিশ্বাসের হাতটাই আজও পরস্পরের সঙ্গী

 

নাতি বলল- "তোমার ভয় লাগতো না"

আমি হেসে বললাম- "তোমার ঠাকুরমা আমার পাশে ছিলেন যে.........হা হা হা"




লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী

আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।

ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com

লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।

ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top