জাতীয় উন্নয়ন ও শিক্ষার লক্ষ্য : গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ -সৌমেন দাস || নিবন্ধ || অকপট অনুসন্ধান

0

ভূমিকাঃ

শিক্ষা হল মানব সমাজের সর্বাধিক শক্তিশালী পরিবর্তনকারী শক্তি। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনায় শিক্ষাকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া হয়েছে। কারণ শিক্ষার মাধ্যমে কেবল ব্যক্তিগত উন্নয়ন নয়, বরং জাতীয় পরিচয়, সংস্কৃতি, সামাজিক ন্যায়বিচার, উৎপাদনশীলতা ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি একসাথে সম্ভব। জাতীয় শিক্ষা বলতে বোঝায় এমন এক শিক্ষা ব্যবস্থা, যা জাতির সামগ্রিক উন্নয়নকে সামনে রেখে গড়ে ওঠে। জাতিকে বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল বা উন্নত দেশের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে শিক্ষার লক্ষ্যসমূহ স্পষ্ট, সময়োপযোগী ও বাস্তবায়নযোগ্য হতে হবে। নিচে জাতীয় বিকাশের জন্য শিক্ষার প্রধান লক্ষ্যসমূহ গবেষণামূলক আলোচনায় উপস্থাপন করা হল।

১. জাতীয় চেতনার উন্মেষঃ

জাতীয় উন্নয়নের অন্যতম প্রথম শর্ত হল প্রতিটি মানুষের মধ্যে গভীর জাতীয় চেতনা জাগ্রত করা। জাতীয় চেতনা বলতে বোঝায় দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ, সাংবিধানিক মূল্যবোধ এবং নাগরিক দায়িত্ববোধ। কোঠারি কমিশন (১৯৬৪-৬৬) এবং জাতীয় শিক্ষানীতি (২০২০) উভয়েই উল্লেখ করেছে যে শিক্ষা কেবল তথ্য ও দক্ষতা প্রদান নয়, বরং জাতীয় চেতনা বিকাশের হাতিয়ার। যদি শিক্ষার মাধ্যমে দেশের প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ গড়ে না ওঠে, তবে জাতির অগ্রগতি ব্যাহত হবে। তাই বিদ্যালয় পর্যায় থেকেই শিক্ষার্থীদের জাতীয় ইতিহাস, স্বাধীনতা সংগ্রাম, সাংবিধানিক অধিকার ও কর্তব্য সম্পর্কে অবহিত করা জরুরি।

২. ঐতিহ্যের সংরক্ষণ ও নবায়নঃ

শিক্ষার আরেকটি লক্ষ্য হল জাতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ। ভারত বহু ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের দেশ। শিক্ষা যদি এই বহুত্ববাদী ঐতিহ্যকে সঠিকভাবে প্রতিফলিত না করে, তবে জাতীয় ঐক্য দুর্বল হয়ে যাবে। শিক্ষার মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে অজন্তা-ইলোরা, মোহনজোদড়ো, বেদ-উপনিষদ থেকে রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী—সব ঐতিহ্যের ধারক হিসাবে গড়ে তোলা যায়। তবে সংরক্ষণ মানে অন্ধ অনুকরণ নয়; বরং জাতীয় উন্নয়নের আলোকে ঐতিহ্যের নবমূল্যায়ন ও সৃজনশীল রূপান্তরও প্রয়োজন।

৩. নিরক্ষরতা দূরীকরণঃ

জাতীয় অগ্রগতির সবচেয়ে বড় বাধা হল নিরক্ষরতা। স্বাধীনতার সময় (১৯৪৭) ভারতের সাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৮.৩৩%। বর্তমানে (জনগণনা ২০১১) তা বেড়ে প্রায় ৭৪% হয়েছে, কিন্তু এখনো কোটি কোটি মানুষ নিরক্ষর। নিরক্ষরতা ব্যক্তিকে যেমন অজ্ঞতার অন্ধকারে রাখে, তেমনি সমাজজীবনে দারিদ্র্য, কুসংস্কার ও অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। তাই জাতীয় বিকাশের জন্য সরকারের দায়িত্ব হল—বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা, প্রাথমিক শিক্ষাকে সর্বজনীন করা এবং ডিজিটাল সাক্ষরতা প্রচার করা। সর্বশিক্ষা অভিযাননতুন শিক্ষা নীতি ২০২০ এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

৪. শিক্ষায় সমান সুযোগ ও অধিকারঃ

একটি দেশের জাতীয় বিকাশ তখনই সম্ভব যখন সমাজের প্রত্যেকটি স্তরের মানুষ সমান সুযোগে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে। জাত, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাইকে শিক্ষা ক্ষেত্রে সমান সুবিধা দিতে হবে। শিক্ষার নিম্নস্তর থেকে উচ্চস্তর পর্যন্ত দরজা সবার জন্য খোলা রাখতে হবে। ভারতের সংবিধান অনুযায়ী আর্টিকেল ২১এ শিশুদের জন্য বিনামূল্যে ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার দিয়েছে। একইসাথে জাতি ও লিঙ্গ বৈষম্য দূরীকরণে সংরক্ষণ নীতিও সমান সুযোগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখছে।

৫. জীবনের প্রয়োজনে শিক্ষাঃ

শিক্ষা তখনই কার্যকর হয় যখন তা জীবনের প্রয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকে। কেবল বই-পুস্তক নির্ভর শিক্ষা নয়, বরং শিক্ষা হতে হবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য। আধুনিক সমাজে প্রযুক্তি, অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, পরিবেশ, গণতন্ত্র—সব ক্ষেত্রেই শিক্ষার সরাসরি প্রয়োগ থাকতে হবে। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ জীবনদক্ষতা (life skills), ডিজিটাল জ্ঞান, সমালোচনামূলক চিন্তাশক্তি, যোগাযোগ দক্ষতা ও সৃজনশীলতাকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। জাতীয় উন্নয়নের জন্য শিক্ষা হবে এমন, যা ব্যক্তি ও সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে পারে।

৬. উৎপাদনমুখী শিক্ষাঃ

আধুনিক যুগে শিক্ষা কেবল জ্ঞান আহরণ নয়, বরং উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রসারে জাতীয় জীবনে নতুন চাহিদা তৈরি হয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে বেকারত্ব বেড়ে যাচ্ছে। তাই শিক্ষাকে বৃত্তিমুখী ও কারিগরি শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। পলিটেকনিক, আইটিআই, ভোকেশনাল কোর্স, স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ইত্যাদি উদ্যোগের মাধ্যমে শিক্ষা উৎপাদনমুখী রূপ নিচ্ছে। জাতীয় বিকাশের জন্য প্রয়োজন প্রতিটি শিক্ষার্থীকে কর্মসংস্থানের উপযোগী করে তোলা।

৭. মানবসম্পদ বিকাশঃ

জাতীয় শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নের হাতিয়ার। মানবসম্পদ বলতে বোঝায় জাতির মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা, স্বাস্থ্য ও সৃজনশীলতা। ড. অমর্ত্য সেন বলেছেন, “মানুষই উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি।” তাই শিক্ষা হতে হবে এমন, যা মানুষকে কেবল চাকরিপ্রার্থী নয়, বরং উদ্ভাবক, উদ্যোক্তা ও দায়িত্বশীল নাগরিক করে তোলে। মানবসম্পদ উন্নয়ন মানে স্বাস্থ্যসেবা, সামাজিক সচেতনতা, দক্ষতা প্রশিক্ষণ ও উদ্ভাবনী শক্তির বিকাশ। শিক্ষার মাধ্যমে মানবসম্পদ যত বেশি উন্নত হবে, জাতীয় উন্নয়ন তত দ্রুত এগোবে।

৮. জনশিক্ষা ও জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণঃ

ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সমস্যা দীর্ঘকাল ধরে জাতীয় উন্নয়নের পথে বড় বাধা। দারিদ্র্য, কুসংস্কার, কম বয়সে বিবাহ, পরিবার পরিকল্পনার অভাব—সব মিলিয়ে জনসংখ্যা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে। তাই শিক্ষার মাধ্যমে জনসচেতনতা তৈরি করা অপরিহার্য। বিদ্যালয় স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের পরিবার পরিকল্পনা, নারী-পুরুষ সমতা, স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে শিক্ষা দিতে হবে। জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিল (UNFPA) অনুযায়ী, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে শিক্ষা সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার।

৯. ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাঃ

জাতীয় সংহতি রক্ষার জন্য শিক্ষা হতে হবে সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষ। ভারতের সংবিধান রাষ্ট্রকে ধর্মনিরপেক্ষ বলে ঘোষণা করেছে। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো বিশেষ ধর্ম চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। বরং শিক্ষা হবে এমন, যা সকল ধর্মের প্রতি সহনশীলতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলে। ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা ছাড়া জাতীয় ঐক্য অটুট রাখা সম্ভব নয়।

উপসংহারঃ

জাতীয় উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি হল শিক্ষা। শিক্ষা ছাড়া দারিদ্র্য দূরীকরণ, বেকারত্ব নিরসন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার—কোনো কিছুই সম্ভব নয়। তাই শিক্ষা হবে বহুমুখী, অন্তর্ভুক্তিমূলক, উৎপাদনমুখী, জীবনের সঙ্গে যুক্ত ও সময়োপযোগী। শিক্ষা যদি জাতির মধ্যে জাতীয় চেতনা, ঐতিহ্যের মূল্যবোধ, সমতা, মানবসম্পদ বিকাশ ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে, তবে ভারত কেবল উন্নয়নশীল নয়, উন্নত দেশের সারিতেও স্থান করে নিতে পারবে।

তথ্যসূত্রঃ

  1. কোঠারি কমিশন রিপোর্ট (১৯৬৪–৬৬)

  2. জাতীয় শিক্ষানীতি ১৯৮৬ ও ২০২০, ভারত সরকার

  3. জনগণনা রিপোর্ট (১৯৫১, ২০১১), ভারত

  4. UNESCO, Education for Sustainable Development, 2015

  5. UNFPA, World Population Report, 2021

  6. অমর্ত্য সেন, Development as Freedom, 1999

*****


লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী

আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।

ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com

লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।

ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top