পুরাকীর্তি ও প্রত্নতত্ত্বের জেলা দক্ষিণ দিনাজপুর-ড: সমিত ঘোষ || প্রবন্ধ || অকপট অনুসন্ধান
Editor
মঙ্গলবার, অক্টোবর ২৮, ২০২৫
0
পুরাকীর্তি ও প্রত্নতত্ত্বের জেলা দক্ষিণ দিনাজপুর-ড: সমিত ঘোষ
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার আঞ্চলিক ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ। সুপ্রাচীন
এই ভূখণ্ড নানা ইতিহাসের স্বাস্থ্য বহন করে চলেছে।৮ টি থানা- বালুরঘাট, হিলি, কুমারগঞ্জ, তপন, গঙ্গারামপুর, বংশীহারী,হরিরামপুর, কুশমন্ডি এ নিয়েই দক্ষিণ দিনাজপুর।
১।বালুরঘাট- বালুরঘাটের অদূরে রয়েছে পতিরাম।পতিরাম থেকে
সামান্য দূরত্বে রয়েছে নাজিরপুর স্তূপ।জনশ্রুতি অনেক কিন্তু খনন না করলে বলা যাবে না কি আছে।
গোপালবাটি অঞ্চল এ আছে কৈগ্রাম।এই গ্রামের জঙ্গলের মধ্যে রয়েছে একটি বৌদ্ধ
উপাসনাগৃহ।পতিরামে রয়েছে প্রাচীন বিদ্যেশ্বরী মন্দির।পতিরামের পাশেই আছে খাঁপুর
গ্রাম।তেভাগা আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান,ধানের দাবিতে কত রক্ত ঝরেছে, খাঁপুরেই আছে সিংহবাহিনী মন্দির।টেরাকোটার অপূর্ব নিদর্শন।ভাতশালা
জেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম।সেখানে কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে।সুলতান
রুকনদ্দিন বারবক শাহের আমলে বারবাকাবাদের প্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল সন্তোষ। মাহিসন্তোষ
যাবার জন্য সুলতান ভাতশালায় উপস্থিত হয়ে দেখেন সামনে রয়েছে বড় নদী গৌড়েশ্বর
ফিরে যান।কামরূপ রাজ কামেশ্বরের সঙ্গে বারবাক শাহের সেনাপতি ইসমাইল গাহির যুদ্ধ
হয় মাহিসন্তোষ মাঠে।বর্তমানে মাহিসন্তোষ দিনাজপুরে।৪২-এর আন্দোলনে ভাতশালা একটি
বড় কেন্দ্র ছিল।বোল্লা গ্রামের পুজো জেলার অন্যতম বড় পূজা।
Image:নাজিরপুর স্তূপ , পতিরাম, Capture By : লেখক
Image: তেভাগা আন্দোলনের স্মারক, বালুরঘাট, Capture By: সৌমেন দাস
২।গঙ্গারামপুর-গঙ্গারামপুরের অন্যতম পুরাক্ষেত্র হলো বাণগড়।১৯৩৮-৪১, ২০০৭, ২০০৯-১০ প্রত্নখনন হয়।ধলদীঘি, কালদীঘি, আতাসাহের দরগা, করম আলী টাট শাহির মাজার, নারই, পীরপাল এসব নিয়ে গঙ্গারামপুর আজও উজ্জ্বল ইতিহাসের সাক্ষ্য
বহন করে চলেছে।
Image: ঐতিহাসিক বানগড়, গঙ্গারামপুর, Capture By: সৌমেন দাস
Image: ২০০৯-১০ প্রত্নখননে প্রাপ্ত সামগ্রী, বানগন, Collection By লেখক
৩।তপন- তপন দিঘি জেলার অন্যতম বড় দিঘি।এখানেই মিলেছে সেন রাজা লক্ষণ সেনের তর্পণ ঘাট লিপি।দিঘির
উত্তরে একটি প্রাচীন বৌদ্ধবিহারের ধ্বংসস্তূপ পাওয়া গেছে।স্তূপটি খনন করলে অনেক
তথ্য পাওয়া যাবে।তপন থানার ভিকাহারে একটি দেবস্থান আছে সেটি বাসন্তী দেবী বলে
পরিচিত।ভিকাহারে মকদুম শাহ জালালের দরগা আছে।তিনি পারস্যের তাব্রিজ শহর থেকে এখানে
এসেছিলেন।ইবন বতুতার লেখায় মখদুম শাহ জালালের কথা আছে।তিনিভিকাহারে উরস উৎসব চালু করেন।ভায়োরেরয়েছে একটি ভগ্নপ্রায় দশভূজার মূর্তি।স্থানীয়
মানুষের কাছে মায়ের থান।অনেকে বলেন ভৈরবের মূর্তি এটি।তপন থানার মনোহোলি থেকে পালরাজ মদন পালের দ্বাদশ শতকের একটি
তাম্রপত্র পাওয়া গেছে।করদহও পোড়াগাছিতে
রয়েছে প্রাচীন টেরাকোটার মন্দির।করদহ ও বাসরে দুটো দরগাও রয়েছে।রয়েছে পুরাভূমি দীপখন্ড।ধীমান ও বিটপালেরনামের সঙ্গে জড়িত, তপন থানার মনোহলীতে রয়েছে জমিদার বাড়ি।
Image: তপন দিঘী, তপন , Capture By: সৌমেন দাস
Image:মনোহলী জমিদার বাড়ি, Capture By: লেখক
৪।কুশমন্ডি- জেলার উত্তর প্রান্তে অবস্থিত।এই জেলার অন্যতম
জলাশয় মহিপাল দিঘি কুশমন্ডি থানার অন্তর্গত।পালরাজা দ্বিতীয় মহিপালের নামানুসারেই
দিঘির নাম মহিপাল দিঘি।দিঘির পারেই কেরি সাহেবের বন্ধু টমাস সাহেবের নীলকুঠি
ছিল।পন্ডিত গোলকনাথ শর্মা কেরীর মুন্সি ছিলেন। তিনি সংস্কৃত 'হিতোপদেশ' প্রথম বাংলায় অনুবাদ করেন।১৯৬১ সালের West
Dinajpur Census Hand Book থেকে
জানা যায় যে দিনাজপুরে নীল চাষ হতো।দ্বিতীয় মহিপালের কর্মচারী কৈবর্ত
সম্প্রদায়ের দিব্য, ভীম ও রুদ্রকের সঙ্গে দ্বিতীয় মহিপালের লড়াই হয় যা কৈবর্ত
বিদ্রোহ নামে পরিচিত।কুশমন্ডি থানার ছোট্ট গ্রাম করণজি।এটি কংসব্রতের জন্য
বিখ্যাত।এখানে ত্রয়োদশ শতকের একটি ত্রি বিক্রম এর মূর্তি পাওয়া
গেছে।কুশমন্ডি ও সন্নিহিত অঞ্চলের খন গান জেলার গর্ব।মহিষবাথানের মুখোশ শিল্প আজ
জেলা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক দরবারে সুপ্রতিষ্ঠিত।
Image: মহিপাল দিঘি, মহিপাল, Capture By: সৌমেন দাস
Image: মহীপাল দিঘী নীল কুঠির, Capture By: লেখক
৫। বংশীহারী- পুরাতত্ত্বে সমৃদ্ধ এই অঞ্চল।এই থানার
পশ্চিমাঞ্চলে রয়েছে একডালা।সুলতানি আমলে এখানে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ গড়ে ওঠে।দিল্লির
সুলতান ফিরোজ শাহের আক্রমণ প্রতিহত করতে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন গৌড়ের সুলতান
ইলিয়াস শাহ ও সেকেন্দার শাহ।স্টেপল টনের মতে এটি হোসেন-শাহ এর বাসস্থান।সরসীকুমার
সরস্বতী চিরামতি ও বালিয়া নদীর অঞ্চল পায়ে হেঁটে পরিদর্শন করেছেন।ওয়েষ্টমেকটও লিখেছেন।এখানকার জগদলা গ্রামে অবস্থিত জগদ্দল
মহাবিহার।সম্ভবত বক্তিয়ার খিলজি ১২০২-০৩ খ্রী: নাগাদ এই মহাবিহার ধ্বংস করেন।বংশীহারী
থেকে পাল সেন যুগের প্রচুর মূর্তি পাওয়া গেছে।পুন্ডিগ্রাম, কুমার দিঘি হল অন্যতম অঞ্চল।বালুরঘাট কলেজ ও জেলা
সংগ্রহসালাতে এইসব মূর্তি সংরক্ষিত আছে।
Image: একডালা দুর্গের এক খন্ড পাথর, Capture By: সৌমেন দাস
৬। কুমারগঞ্জ- এই থানার বটুন পুরাকীর্তি সম্বনিত অঞ্চল।অনেক গবেষক বলেন, সন্ধ্যাকর নন্দীর জন্মস্থান হল বটুন গ্রাম।কুমারগঞ্জের
নাককাটি থেকে বর্মন পাড়া অঞ্চল পুরাক্ষেত্র হিসেবে প্রসিদ্ধ বর্মনপাড়াতে কিছু
প্রত্নকীর্তি আছে।দেবী চৌধুরানী সঙ্গে এই অঞ্চলের যোগাযোগ ছিল।এখানকার মন্দিরে
পুজো দিয়ে ময়ূরপঙ্খী নাও নিয়ে তিনি বের হতেন।কুমারগঞ্জের দেবগ্রাম, মোহনা, বৈদ্যনাথ ধামে(দাউদপুর) ইতিহাসের গন্ধ লেগে আছে।উপেন সাধুর
ওখানে অনেকগুলি গৌরীপট আছে দেবগ্রাম অর্থাৎ দেবতার গ্রাম।শিব মন্দির, দোলমঞ্চ, আরো অনেক কিছু।খোট্টাপাড়া ও জয়ন্তিহারে রয়েছে জমিদার বাড়ি।তবে তা প্রায়
ধ্বংস প্রাপ্ত।
Image: উপেন সাধুর গৌরীপট, Collection By: লেখক
৭।হিলি-জেলার সীমান্ত লাগোয়া থানা হিলি।এখানকার মাতাস গ্রামে ‘রাজারভাঙ্গা’ বলে
একটি উঁচু ঢিবি আছে।বিনশিরা ও পাঞ্জুলে কিছু প্রত্ননিদর্শন আছে।বিনশিরার রথযাত্রা
উৎসব বেশ প্রাচীন।কুর্মাইলে আছে প্রাচীন মসজিদ ও ওয়াকর্ফ এস্টেট।হিলিতে একটি জৈন
মন্দির আছে।জেলার সবচেয়ে প্রাচীন কুমুদনাথ পাবলিক লাইব্রেরী(1896)।তিওরে রয়েছে ফেরুসা মাসান কালীবাড়ি।বইগ্রামে একটি
তাম্রশাসন মিলেছে।
Image: চামুণ্ডা কালী, ত্রিমোহিনী, হিলি, Capture By: লেখক
৮। হরিরামপুর-মহাভারতের স্মৃতি পটভূমিকায় অলোকিত বৈরাট্টা
গ্রাম।এখানকার একদম সীমান্ত ও উত্তর
দিনাজপুর লাগোয়া গ্রাম আমাতি।অনেকে বলেন পাল রাজধানী রামাবতী ই বর্তমান নাম
আমাতি।জনশ্রুতি মহাভারতের বিরাট রাজার বাড়ি ছিল বৈরাট্টা গ্রামে।এখানে রয়েছে সুপ্রাচীন শমীবৃক্ষ।আমাতিতে প্রচুর দেবদেবীর
মূর্তি পাওয়া গেছে।পাল সেন যুগের বুদ্ধমূর্তি, বিষ্ণু, গণেশ, সরস্বতী ও সূর্য মূর্তি পাওয়া গেছে।হরিরামপুরে রয়েছে আলতা
দীঘি,মালিয়ান দিঘি, গড় দিঘি,হাতিডোবা দিঘি ইত্যাদি।হরিরামপুরের মহেন্দ্র গ্রামে একটি ঢিবি রয়েছে নাম
গদাধাম।কিংবদন্তি এই গ্রামেই রয়েছে আরো কিছু ঢিবি।মাঝে মধ্যেই উঠে আসে নানা প্রত্নসামগ্রী।
দক্ষিণ
দিনাজপুর জেলা হলো প্রত্নকীর্তি পুরাতত্ত্বের স্বর্গভূমি।মাটির নিচে প্রথিত আছে
ইতিহাসের নানা পুরাগল্প, পুরাকথা ও কিংবদন্তি।ক্ষেত্রসমীক্ষায় আজও খুঁজে পাওয়া যায়
ইতিহাসের কত কথা।কোদালের
কোপে মাটির প্রোথিত ইতিহাস আজ ও জীবন্ত হয়ে ওঠে।দিঘি সংস্কারে
বা পুকুর খননে পুরোনো ইতিহাস কথা বলে।কোন বিল্ডিংয়ের ভিত খুঁড়তে গিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চলের ইতিহাস
রঙিন পাখনা মেলে।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার ইতিহাস এভাবেই বয়ে
চলেছে।
ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ, ওয়েষ্ট বেঙ্গল হেরিটেজ কমিশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ এবং প্রশাসন যদি যৌথ ভাবে উদ্যোগী
হয় তবে এই জেলার ইতিহাস ও পুরাকীর্তিকে এখনও বাঁচানো সম্ভব।সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে বরেন্দ্রভূমির সমৃদ্ধ ইতিহাস ও পর্যটন
জেলার অর্থনীতিকে নিশ্চয় সমৃদ্ধি করবে। কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ ১।দক্ষিণ
দিনাজপুরের পুরাকীর্তি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও ইতিহাস- সমিত ঘোষ, ২।উত্তরবঙ্গের
পুরাকীর্তি ও ইতিহাস, প্রথম
খণ্ড- ডঃ সমিত ঘোষ, ৩।মধুপর্ণী- পশ্চিম দিনাজপুর জেলা সংখ্যা (১৩৯৯ বঙ্গাব্দ), ৪।ব্যক্তি
ঋণঃ প্রফেসর আনন্দ গোপাল ঘোষ, ডঃ কমলেশ চন্দ্রদাস, কৌশিক বিশ্বাস, জয়ন্ত আচার্য ও সৌমেন দাস।
লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী
আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।
ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com
লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।
ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।