বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-শিবব্রত গুহ || প্রবন্ধ || অকপট অনুসন্ধান

0

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন বাংলা সাহিত্যের একজন মহীরুহ। তিনি নানা ভাবে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন। তিনি সৃষ্টি করেছিলেন বাংলা সাহিত্যের এক নতুন দিগন্ত।যার নাম ছোটগল্প।এই ছোটগল্প আজ বাংলা সাহিত্যে খুবই জনপ্রিয়। গল্পগুচ্ছ হল কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের এক সংকলন। এই সংকলন এককথায় অনবদ্য। একে বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ বলা যেতে পারে।

কবিগুরু ১২৯৮ থেকে ১৩১০ বঙ্গাব্দের মধ্যে, এই ছোটগল্পগুলোর অধিকাংশ লিখেছিলেন। এর অখন্ড সংস্করণে মোট গল্প আছে ৯১ টি। এর কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ছোটগল্পের নাম হলঃ যথা -
১৷ মুকুট।
২। দেনাপাওনা।
৩। পোস্টমাস্টার।
৪। রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা।
৫। ব্যবধান।
৬। খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন।
৭। কাবুলিওয়ালা।
৮। ছুটি।
৯। সুভা।
১০। দানপ্রতিদান। প্রভৃতি।

এই গল্পগুলো প্রত্যকটাই অসাধারণ। এর কোন তুলনাই হয় না। কবিগুরুর এই ছোটগল্পগুলো বিভিন্ন সময়ে নানা পত্রিকায় হয়েছে প্রকাশিত। তাঁর প্রথম ছোটগল্পের নাম হল ভিখারিণী। এটি ১৮৭৪ সালে, প্রকাশিত হয়েছিল ভারতী পত্রিকায়।পরবর্তীকালে, ১৮৮৪ - ৮৫ সালে ঘাটের কথা, রাজপথের কথা ও মুকুট প্রকাশিত হলেও,তাঁর প্রথম সার্থক ছোটগল্পের নাম হল দেনাপাওনা। এই গল্পটি হিতবাদী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯১৪ সালে, নারীর ব্যক্তিত্বের মহিমা, অধিকার, সচেতনতা, মর্যাদাবোধ চিত্রায়িত করেছিলেন তিনি হৈমন্তী, অপরিচিতা, স্ত্রীর পত্র ছোটগল্পসমূহে।তবে উপন্যাসের মতো ছোটগল্পের আদি উৎসভূমি হল ইউরোপ। ইউরোপীয় সমাজে, প্রবহমান রূপকথা, লোকগাথা বা রোমান্সকাহিনী - যা ছিল মানুষের মনোরঞ্জনের অন্যতম মাধ্যম। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলেন বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের প্রাণ - প্রতিষ্ঠাকারী। তাঁর হাতেই ঘটে বাংলা ছোটগল্পের উজ্জ্বল মুক্তি।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মানুষের মনের নাগাল খুব ভালো ভাবে পেয়েছিলেন। তাঁর ছোটগল্পগুলোতে, মানুষের সুখ, দুঃখ, ব্যথা, বেদনা, যন্ত্রণা, আনন্দ, কষ্ট খুব সুন্দর ভাবে হয়েছে প্রতিফলিত। তাই তো, আজও তাঁর রচিত ছোটগল্পগুলো জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে কবিগুরুর রচিত ছোটগল্পগুলোর, নারীচরিত্র এককথায় অসাধারণ।এক - একটি নারীচরিত্র  এক - একরকমের। তিনি নারীদেরকে খুব সুন্দর ভাবে উপস্থাপিত করেছেন। এটা কিন্তু চোখে পড়ার মতো।রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত দেনাপাওনা ছোটগল্পের নারীচরিত্র হল নিরুপমা। খুব সুন্দর ভাবে এই নারীচরিত্র কবিগুরু রচনা করেছেন। আমাদের সমাজে একটি প্রথা বহুদিন থেকেই এই সমাজের চরম ক্ষতি করে চলেছে। আমাদের সভ্য সমাজের বুকে এইরকম একটা ঘৃণ্য প্রথা কিকরে এখনো বিরাজ করে আছে? তা ভাবলেও হতে হয় অবাক।

বাংলা সাহিত্যে এই বর্বর পণপ্রথার বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি তাঁর রচিত ছোটগল্প দেনাপাওনাতে। আমাদের সভ্য সমাজে পণপ্রথার বিষময় ফল কবিগুরু খুব সুন্দর ভাবে এই ছোটগল্পে তুলে ধরেছেন। একজন মেয়ে অল্প বয়সে, যখন বিয়ে করে নতুন বউ হয়ে নতুন সংসারে আসে, তখন সে অনেক স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকে।কিন্তু, তার সেই স্বপ্ন ভেঙে যায় শ্বশুরবাড়ীতে এসে। সেখানে, এসে সে শ্বশুরবাড়ীর লোকেদের অবহেলা, অপমানের শিকার হয় বারবার। সে, শেষপর্যন্ত, পণপ্রথার বলি হয়েছিল। এইরকম অনেক নিরুপমা, আজও আমাদের সভ্য সমাজে হয়ে চলেছে পণপ্রথার শিকার।এটা কি আমরা অস্বীকার করতে পারি আধুনিক মানুষের বিচ্ছিন্নতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পের অন্যতম প্রতিপাদ্য বিষয়।যুগলের নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্র ছোটগল্পের নরনারীকে বিচিত্র জীবন জটিলতার সামনে দাঁড় করিয়েছে। স্বামী - স্ত্রীর মধ্যে, নিঃসঙ্গতা রবীন্দ্র ছোটগল্পে  অনেক সময়ে সামাজিক অর্থনৈতিক কারণের সূত্র ধরে উপস্থিত হয়েছে।

যুদ্ধোত্তর বিচ্ছিন্নতাবোধের সাথে রবীন্দ্রনাথের বিচ্ছিন্নতাকে এককরে দেখা ঠিক হবে না। নরনারীর বিযুক্তি ও বিয়োগ কবিগুরুর অনেক গল্পেই আমরা দেখতে পাই। দৃশ্যপটের অগ্রভূমি চলমান রেখে, পটভূমির নৈঃসঙ্গ, নৈঃশব্দ্য ও মন্থরগতিকে তিনি কখনো কখনো ব্যবহার করেছিলেন রস - পরতান্ত্রিক হিসাবে।তার উদাহরণ আমরা পাই তাঁর রচিত " খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন " ছোটগল্পে। " রাইচরণ ধীরে ধীরে গাড়ি ঠেলিয়া ধানক্ষেত্রের প্রান্তে নদীর তীরে আসিয়া উপস্থিত হইল।নদীতে একটিও নৌকা নাই, মাঠে একটিও লোক নাই- মেঘের ছিদ্র দিয়া দেখা গেল, পরপারে জন হীন বালুকাতীরে শব্দহীন দীপ্ত সমারোহের সহিত সূর্যাস্তের আয়োজন হইতেছে। সেই নিস্তব্ধতার  মধ্যে শিশু সহসা এক দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া বলিল, " চন্ন, ফু। "

বাংলা ছোটগল্পের ইতিহাসে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই হলেন প্রথম শিল্পী, যিনি সযত্নে পরীক্ষায় রচনা করেছেন ছোটগাল্পিক ভাষাশৈলী। শুধু বাংলা ছোটগল্পের জন্যই, যে একটি আলাদা ভাষারীতির খুব প্রয়োজন রয়েছে, তা তিনি অনুভব করেছিলেন মনে প্রাণে। এক্ষেত্রে, তিনি রেখে গিয়েছেন এক অনন্য কৃতীর স্বাক্ষর।কবিগুরুর হাত ধরেই বাংলা ছোটগল্প হয়ে ওঠে নাবালক থেকে সাবালক। তিনি বাংলা ছোটগল্পকে ভরিয়ে দিয়েছেন বিষয় - বৈচিত্র‍্যে।তিনি করেছেন একে নানা বর্ণে শোভিত। তিনি একক সাধনায়, বাংলা ছোটগল্পকে নিয়ে গেছেন খ্যাতির শীর্ষচূড়ায়। এক্ষেত্রে, তাঁর অবদান অনেকখানি। তিনি অসম্ভবকে করেছেন সম্ভব।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্পে বাংলাদেশের বিখ্যাত নদী পদ্মার প্রভাব অনেক। পদ্মার ওপরে বোটে ভেসে, ভেসে, তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন মানবজীবনের নানা অনুভূতি, সংগ্রাম ও বিক্ষোভের ছবি। তিনি যে জীবনকে নিজের চোখ দিয়ে, দেখেছেন, তার প্রমাণ পাই তাঁর রচিত ছোটগল্পে। বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের স্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং এই বিষয়ে তাঁর কৃতিত্ব সব প্রশংসার ঊর্ধ্বে।
( লেখক কর্তৃক তথ্য সংগৃহীত)






লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী

আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।

ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com

লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।

ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top