দীর্ঘদিন হয়ে গ্যালো,দীর্ঘ ৭৪ বছর হোলো ভারত স্বাধীন হয়েছে।এই ৭৪ বছর ধোরে চুয়াত্তর ধরণের পরিবর্তন,নিত্য নতুন আইন,রোজ কোনো না কোনো রাজনৈতিক পার্টির আভ্যন্তরীণ গন্ডগোল এটাই যেনো এখনকার রোজকার দিনযাপন।বেশ বড়- প্রায় দেড় হাজার স্কোয়ার ফিটের ফ্ল্যাটের দক্ষিণ খোলা বেশ চওড়া বারান্দায় বছর পঞ্চাশের নীলিমা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে আর ফ্ল্যাটের অনতিদূরে ক্যাম্পাসের ক্লাবের পতাকা উত্তোলন দেখছে।
'ঠাম্মি ও ঠাম্মি'বোলে এগিয়ে এসে বছর আটেকের সুমি নীলিমার পাশে দাঁড়ালো। সুমি নিলয়ের একমাত্র মেয়ে।নিলয় আজ সীমান্তে স্বাধীনতা দিবস উদযাপনে ব্যাস্ত।সিনিয়র অফিসার ইনচার্জ হিসেবে তার অনেক কাজ আজ।নিলয় কে এই স্বাধীনতার দিনে তার ছোট্ট সুমি একটা সারপ্রাইস দেবে।সেই কথাটাই ঠাম্মিকে বোলবে বোলে এসে দাঁড়ালো বারান্দায়।সুমি ঠাম্মিকে পতাকা উত্তোলনের জন্য যে গান গাইতে যাবে সেকথা বোলেই সে ছুটে ক্যাম্পাসের অনুষ্ঠানে চোলে গ্যালো।
পতাকা উত্তোলনের সাথে সাথেই ভারতের জাতীয় সঙ্গীতের সুর যেনো নীলিমাদের গোটা ক্যাম্পাস ভোরে একটা সুন্দর অনুভূতির বাতাবরণ তৈরী কোরলো।নীলিমা খেয়ালই করে নি কখন জয়ী এসে পাশে দাঁড়িয়ে এক মনে ক্যাম্পাসের অনুষ্ঠান দেখছে বিভোর হয়ে।আজ জয়ীর মনে পড়ছে , হ্যা,বড্ড মিস কোরছে নিলয় কে।পতাকা উত্তোলন ই শুধু নয়,জয়ী দেখেছে দেশকে কি গভীর ভাবে ভালোবাসে নিলয়। কিন্তু জয়ী মাঝে মধ্যে অতীতের কথা ভেবে মন ভারী করে। আর কোরবে নাই বা কেনো,সেও তো সুমি হওয়ার আগে এম. এন. সির একক্সিকুটিভ পদে সে তার মনের শান্তির স্বাধীনতা পেয়েছিলো। জয়ীও চেয়েছিলো মনের শান্তির নীড়ের সাথেই নিজের সংসারের নীড়কে মজবুত কোরতে। কিন্তু পারেনি ।
না,না,বাড়িতে নীলিমা আর জয়ীর স্বশুরমাশাই শুভজিৎ সরকার ,যিনি একটা নাম করা ব্যাংকের ম্যানেজার ছিলেন , এরা কেউই জয়ীকে তার নিজের স্বাধীনতার বিসর্জন দিতে বলেনি । কিন্তু নিলয়ের পোস্টিং বর্ডারে হওয়ায় জয়ী,সুমি হওয়ার পরে চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছিলো।সেদিনে স্বশুরমশাই এর একটা কথা আজও ভোলেনি জয়ী।
শ্বশুরমশাই বোলেছিলেন, 'স্বাধীন ভারতের নাগরিক হয়ে এতোদিন স্বাধীন ছিলি,আজ স্বাধীন ভারতে তুই পরাধীনতার নাগপাশে বন্দী হোলি রে মা ।"মুচকি হেসে নিজেকে নাগপাশেই বন্দী কোরেছিলো সে।তবে নীলিমা বোলেছিলো , "আমি চাই রে,তুই আবার স্বাধীনতার স্বাদ নে,আবার নিঃশ্বাস নে মুক্ত হাওয়ায়।"কিন্তু উপায় ছিলো না যে জয়ীর। সুমি যে কাউকে কাছে পেতো না । সুমির যে স্বাধীন ভাবে বেড়ে ওঠা হোতো না । সুমির শৈশবের স্বাধীনতার মূল্য সেদিন জয়ী দিয়েছিলো নিজের পরাধীনতাকে মেনে নিয়েই। তবে এই স্বাধীনতায় যে একটা আনন্দের ছোঁয়া আছে। তাছাড়া জয়ী মনে করে খুব ভাগ্য কোরে শ্বশুর-শাশুড়ি পেয়েছে।একদিন নিলয় বোলেছিলো , " জানো আমার বাবা মা স্বাধীনচেতা , তারা ব্যাক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী।" জয়ী তা নিজেও প্রত্যক্ষ করে প্রতি ক্ষণে ক্ষণে আজও। শ্বশুরমশাইকে আজ চার বছর হোলো হারিয়েছে।
এমন উদারমনস্কতার পরিচয় শুধু নিলয়ের মা-বাবার না , এমন মানসিকতা ঘরে ঘরে প্রত্যেক মা-বাবার হওয়া উচিত। এমন চিন্তা ভাবনাকে সম্মান জানানোই উচিৎ। এটাই তো স্বাধীন দেশের আধুনিক চিন্তাধারার বিকাশ। এমন চিন্তাই স্বাধীনতার নবজাগরণের উন্মেষ এই বর্তমান সময়ে। আজ এই স্বাধীনতার দিনেই যেনো জয়ীর এই কথাগুলো মনে পড়ে যায়। সুমির স্কুল ওদের ফ্ল্যাট থেকে বেশ একটু দূরে , আর সুমি যেহেতু অনেক ছোট তাই এই দিন স্কুলে না গিয়ে ক্যাম্পাসে ই পালন করে ১৫ই আগস্ট । ক্যাম্পাসে দেশাত্মবোধক গান , আবৃত্তি আর গানের সাথে নৃত্য প্রদর্শনের মাধ্যমে স্বাধীনতা দিবস উদযাপন কোরে থাকে। "হাম সব ভারতীয় হ্যায় ", বন্দেমাতরম , "হাম হোঙ্গে কামিয়াব" এইসব দেশাত্মবোধক গান গাওয়ার মাধ্যমে সুন্দর কোরে পালিত হয় স্বাধীনতার দিনটি। তারপরে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয় , সুমি সহ আরো ছোট্ট ছোট্ট ক্যাম্পাসের শিশুরা জাতীয় সংগীত পরিবেশন করে।সব শেষে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। বেশ আনন্দেই কাটে সুমির। আজ সুমির নাচ , গান সবকিছুই রেকর্ডিং করা হয়েছে। প্রণব আঙ্কেলকে সুমি বোলেছিলো রেকর্ডিং করার কথা। বিকেলে ওই ভিডিও টা সুমি পাপা কে পাঠাবে আর এটাই হোলো সুমির সারপ্রাইস। দুপুরে তাই চটপট খাওয়া শেষ কোরে সুমি। তারপরই মা কে ভিডিও কল কোরতে বলে।
জয়ীর মনটাও ছটফট কোরছে নিলয়ের সাথে একটু কথা বলার জন্য। তাই জয়ী সুমিকে বলে ,'পাপাই তো ফোন কোরবে বোলেছে বেটা , প্লিজ ওয়েট । '
ওদিকে নীলিমারও ধৈর্য্যের বাঁধ আর মানছে না , কখন যে ছেলের মুখটা দেখতে পাবে সেই উৎকন্ঠায় পারদ চড়ছে। ক্যাম্পাসের মাঠ থেকে ভেসে আসছে
শক্তিদায়িনী দাও মা শক্তি
ঘুচাও দীনতা ভীরু আবেশ
আঁধার রজনী ভয় কি জননী
আমরা বাঁচাবো এ মহাদেশ......
সত্যি এইসব গান শুনতে বেশ লাগে , মন প্রাণ একেবারে জুড়িয়ে যায়। নীলিমা যেনো এই গান শুনলে কোথায় হারিয়ে যায়। ফিরে যায় অতীতে , ত্রিশ বছর শিক্ষকতার সেইসব দিনে । বেশ ছিলো সেই আনন্দমুখর দিনগুলো , স্মৃতিরা সব ভিড় করে নীলিমার মনের মনিকোঠায়।
গতবছর , ঠিক আজকের দিনই পড়েছিলো সীমার ছোট মেয়ে মানে চুমকির বিয়ে। সেদিন বিয়ের নিমন্ত্রণ বজায় রাখতে সকাল সকাল নিলীমারা সপরিবারে সীমার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি ছুটছে , হঠাৎ ই সুমির শরীর টা আনচান কোরছে বোলেই গাড়ি রাস্তার ধারে এক পাশে দাঁড় করানো হোলো , সুমি গাড়ি থেকে নেমে মাথা , ঘাড়ে জল দিচ্ছিল , জয়ী সাহায্য কোরছিলো সুমিকে। গাড়িতে বোসে নীলিমা এদিক-ওদিক দেখছে। হঠাৎ কোরেই একটা জায়গায় গিয়ে ওর চোখ আটকে গ্যালো , আমাদের জাতীয় পতাকা উদীয়মান , তার আপন ছন্দে ভাসমান , হাওয়া কে বন্ধু কোরে তেরাঙ্গা উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ভেসে চলেছে। কিন্তু একটু দূরে কিছু অল্পবয়সী ছেলেরা কি কোরছে ? সে কি ! এ কি দৃশ্য দেখছে নীলিমা , উদ্দাম নৃত্য , তাও পাশে বক্সে গান বাজছে , ' মেরে ফটোকো চিপকালে সাইয়া ফ্যাবিকল সে ' খুব খুব মর্মাহত হোলো নীলিমা । এটাই কি স্বাধীন ভারত ? এই জন্যই কি আঠেরো বছর বয়সে ক্ষুদিরাম দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিলেন ? না না এমন গান , উদ্দাম নাচ আজকের দিনে কাম্য নয়।
নিলীমা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে , সমস্ত রকমের আধুনিকতাই সে মেনে ন্যায় , যে কোনো ধরণের সঙ্গীতই তার খুব প্রিয় কিন্তু আজ এই গান বড়ই বেমানান।সে নিজে লজ্জিত হোলো দেশমাতৃকার কাছে। এরা জানে না আমাদের দেশ ভারতবর্ষ কিভাবে স্বাধীনতা অর্জন কোরেছিলো।ভারতীয় বিপ্লবীরা কতো অত্যাচার , নির্যাতন সহ্য কোরে আমাদের এই স্বাধীন ভারত উপহার দিয়ে গ্যাছেন , জানে না হয় তো এরা। এই বছরের স্বাধীনতায় নীলিমা ক্ষনিকের জন্য হারিয়ে গিয়েছিলো গতবছরের সেই নির্মম সত্যিতে।
হঠাৎ কোরেই টেবিলে রাখা মোবাইল এ গান বেজে উঠলো , ' কারার ওই লৌহকপাট ........' সম্বিৎ ফিরলো নিলীমার। কিন্তু সে হেঁটে আসতে আসতে , এক লাফে দৌড়ে এসে সুমি ধরে ফেললো মুঠোফোন। নিলয় ফোন কোরছে । জয়ী , নীলিমা ওরাও এসে দাঁড়ালো।
---- পাপা তুমি এতো দেরী কেনো কোরলে ?
----- বেটা অভি তো ম্যায় আজাদ হুয়া , (হাসতে হাসতে ) বেটা তুমি রেডি তো , আমি তোমার প্রোগ্রাম দেখবো কিন্তু । আমি ভিডিও কল কোরছি, ............
ভিডিও কল কোরলো নিলয় , জয়ীকে দেখে নিলয় খুব খুশী হোলো , মায়ের সাথেও কথা হোলো নিলয়ের। কলিং বেল টা বাজতেই দরজা খুলে জয়ী দেখলো , প্রণব দাও এসে গিয়েছে।
শুরু হোলো অনুষ্ঠান , জয়ী , নীলিমা সবাই বসে পড়লো , প্রণব পুরো অনুষ্ঠানের ভিডিও কোরবে । এর পরে দেশাত্মবোধক গান , আবৃত্তি নানা ধরণের সুন্দর , বর্ণাঢ্য ছোটো একটা অনুষ্ঠান হোলো। নিলয়ের অনুরোধে জয়ী একটা গান গাইলো , ' একবার বিদায় দে মা ঘুরে আসি ' । আজও জয়ীর গলাটা তেমনই সুমধুর শোনায়। নীলিমাও খুব খুশী হোলো। ফোনের ওপার থেকে নিলয় বোলে ওঠে , '
---- থ্যাংক ইউ , জান , আই মিস ইউ অলওয়েজ ! নিলয়কে সুমি সকালের পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠানের ভিডিও পাঠিয়ে দেবে , একথাও জানিয়ে দিলো ।
নীলিমা ভাবে , তার পরিবার , তার বংশধর সকলের মধ্যেই দেশাত্মবোধের ভাবাবেগ অপরিসীম ।তার নাতনি , এরাই তো ভাবী ভারতবর্ষের যোগ্য সন্তান , যোগ্য উত্তরসূরী। নীলিমা আজ খুব খুশী আজকের দিনে পরিবারের সবার মধ্যে দেশাত্মবোধ দেখে।
আজকের এই দিন ভালো ভাবেই উৎযাপন কোরলো নিলয়ের পরিবার। তারা গোটা সমাজের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে রইলো , তারাই বুঝিয়ে দিলো স্বাধীনতা দিবস কাকে বলে ? আজ এই দুর্নীতিগ্রস্ত দেশে এটাই বুঝি সঠিক স্বাধীনতার উন্মেষ।
এইভাবেই শতাব্দীর সমাজ সংস্কার আন্দোলনের পেছনে বিবিধ প্রেরণা কাজ করে। আমাদের সকলের আত্মমর্যাদাবোধ,আত্মবিশ্বাস ও স্বদেশের জন্য গৌরববোধ সঞ্চারের চেষ্টা থাকাটা বাঞ্চনীয়। আর এর ফলস্বরূপ মানুষের মনে জন্মভূমির প্রতি শ্রদ্ধা,ভক্তি ও ভালোবাসা বৃদ্ধি পায়। ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারের ফলে যে নবজাগরণের সূচনা হয়েছিলো তারই অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হোলো এদেশে জাতীয় চেতনার উন্মেষ।জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষের মূল কারণ ভারতীয় ও ব্রিটিশ স্বার্থের সংঘাত। ইংরেজরা নিজেদের স্বার্থ রক্ষা কোরতে গিয়ে যে শোষণ শুরু কোরেছিলো তার ফলেই সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে অসন্তোষ দানা বেঁধেছিলো।এই অসন্তোষের জন্যই দেশে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটেছিলো।যা কি না আজ এই একবিংশ শতাব্দীতেও প্রবল।তবে এখন ভারতের আভ্যন্তরীণ ঘাত- প্রতিঘাতই মাঝে মধ্যে অনেক জটিলতার সৃষ্টি করে। তাই জয় হোক প্রজন্মের,জয় হোক চিন্তার , জয় হোক তারুণ্যের ।স্বাধীনতা নামক পাখিটি নিঃসংকোচে , উদারচিত্তে ডানা মেলুক উন্মেষের সম্ভাবনার আকাশে।
লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী
আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।
ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com
লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।
ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।


