উত্তরবঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলন- ড: সমিত ঘোষ || প্রবন্ধ || প্রথম পর্ব || অকপট অনুসন্ধান

0

পূর্ণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে উত্তরবঙ্গের মানুষ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে গণসংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা গ্রহণ করে।১৮৫৭ সালে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রথম সক্রিয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সূত্রপাত হয় সিপাহী বিদ্রোহে মঙ্গল পান্ডের হাত ধরে।ওই সময় উত্তরবঙ্গে ইংরেজদের তেমন বিশেষ উল্লেখযোগ্য সেনাছাউনি ছিল না।তবুও ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন ছোট ছোট সেনানিবাসে প্রভাব ফেলে ছিল।সিপাহী বিদ্রোহের পরেও ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করতে ৯০ বছর লেগেছিল।এই দীর্ঘ সময়ে উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামী, জাতীয়তাবাদী নেতা,  বিদ্রোহী, বিপ্লবী ও সাধারণ মানুষ শহর থেকে গ্রাম, গ্রাম থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্রিটিশ বিরোধিতায় লিপ্ত হয়।সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়েই বিদ্রোহ, সংঘর্ষ, যুদ্ধ, সত্যাগ্রহ সংঘটিত হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, কালিম্পং, আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, মালদহ ও পশ্চিম দিনাজপুরের (বর্তমান উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর) বিভিন্ন নেতা ও নেত্রীর হাত ধরে ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই চলতে থাকে।বিভিন্ন দেশপ্রেমিকের রক্তে গৌড় বাংলার মাটি লাল হয়ে ওঠে।  দেশমাতৃকার সেবায় উত্তরবঙ্গের মানুষ ব্রিটিশদের বন্দুক ও বেয়নটের সামনে নিজেদের জীবন নিলাম করে দিয়েছিলো।
উত্তরবঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলনকে মূলত দুটি ভাগে ভাগ করা যায়।–

ক) বিদেশি দ্রব্য বয়কট, সত্যাগ্রহ, চরকা কাটা, জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ইত্যাদির মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধিতা করা।

খ) অনুশীলন, যুগান্তর, ব্রতী, স্বদেশ বান্ধব, সাধনা প্রভৃতি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও গুপ্ত সমিতির মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলা।

এছাড়াও উত্তরবঙ্গের মানুষ পিকেটিং, শোভাযাত্রা, মিটিং, পত্র পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনকে তীব্রতর করে তোলে।তা ছাড়াও বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাসবাদি আক্রমণের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের মানুষ ব্রিটিশ শাসন এদেশ থেকে উচ্ছেদ করতে চেয়েছিল।  

ব্রিটিশরা প্রথমে ব্যবসার অজুহাতে ভারতে প্রবেশ করে।১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দে রিচার্ড এডওয়ার্ড প্রথমে উত্তরবঙ্গে আসেন।এর চার বছর পরে মালদহে প্রথম কারখানা স্থাপিত হয়।এভাবে উত্তরবঙ্গের মাটিতে ইংরেজরা প্রথম প্রতিষ্ঠা পায়।এরপর ইংরেজরা পলাশী (১৭৫৭) ও বক্সারের (১৭৬৪) যুদ্ধে জয় লাভ করে এবং দেওয়ানি লাভ (১৭৬৫) করার পর সমগ্র দেশে তারা শোষণ,  নিপীড়ন ও বঞ্চনার খেলায় মেতে ওঠে।এর সঙ্গে জোরদার, জমিদার, মহাজনদের অত্যাচার ও ১৭৭০ (১১৭৬ বঙ্গাব্দ) সালের দুর্ভিক্ষে ব্রিটিশ সরকারের নির্লিপ্ত মনোভাব সাধারণ মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলে।   

উত্তরবঙ্গের প্রথম দিকের ব্রিটিশবিরোধী বিদ্রোহের অন্যতম ছিল সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দের এই বিদ্রোহ বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লেও এর কেন্দ্রভূমি ছিল উত্তরবঙ্গ।১৭৭১ সালে ফকির মজনু শাহের নেতৃত্বে বিদ্রোহীরা ইংরেজ ঘাঁটি আক্রমণ করে। এরপর মজনু শাহের সঙ্গে ভবানী পাঠক, নাটোরের মহারানী দেবী চৌধুরানী ছাড়াও রমজানি শাহ, জরুরী শাহ, নিয়াজ শাহ প্রমূখ বিদ্রোহী ফকিরও সন্ন্যাসীরা ইংরেজদের বিরুদ্ধাচরণ শুরু করেন।রংপুর, মালদহ,  দিনাজপুর ও বগুড়ার বিদ্রোহ সফল হয়।উত্তরবঙ্গের সন্ন্যাসী বিদ্রোহের অন্যতম কেন্দ্র ছিল মালদহ।বিদ্রোহীরা মালদহে আগ্নেয়াস্ত্র তৈরি শুরু করে।দিনাজপুর ও মালদহে বিদ্রোহীরা ১৯ হাজার টাকা লুট করে।সেইসময় সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ ব্রিটিশ শাসনের ভিত  নাড়িয়ে দিয়েছিল।  

১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের প্রভাব উত্তরবঙ্গের মানুষকেও প্রভাবিত করে।এরপর বিভিন্ন উপজাতি ও কৃষক বিদ্রোহ সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়েই  সংগঠিত হয়।ডালহৌসির স্বত্ববিলোপ নীতির প্রভাব ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে পড়েছিল।আর সেই বিদ্রোহের প্রতিচ্ছায়া উত্তরবঙ্গ কেউ পরোক্ষ ভাবে জড়িয়ে ফেলেছিল।তাই এখানকার বিভিন্ন সেনানিবাসে অসন্তোষের ছায়া প্রত্যক্ষভাবে,  প্রকাশ পেয়েছিল।এছাড়া, ব্রিটিশদের ভূমি সংস্কার ও ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে কৃষক ও উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিক্ষোভ দেখা দেয়।ব্রিটিশ সরকারের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলার অর্থনীতি ভঙ্গুর হয়ে পড়ে।তাছাড়া রায়তওয়ারি, মহলওয়ারি ব্যবস্থাও উত্তরবঙ্গের কৃষক সম্প্রদায়ের মানুষকে উদ্বিগ্ন করে তোলে।সাধারণ মানুষ ব্রিটিশদের এইসব একপেশে ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থার জন্য ব্রিটিশ বিরোধী বিক্ষোভে সামিল হয়।উপজাতি সম্প্রদায়ের সাঁওতাল,  ওঁরাও,  মুন্ডা এরাও ইংরেজ বিরোধিতায় অবতীর্ণ হয়।শুধু তাই নয়, এরা জোতদার, মহাজন ও জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সংঘটিত  করতে থাকে।  

ব্রিটিশ সরকার এবং তাদের দোসর এই সুদখোর মহাজন, অত্যাচারী জমিদার, ও জোতদারদের অত্যাচারে সাধারণ মানুষ ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত হয়ে ওঠে।তাই এরা তীর ধনুক, লাঠি, টাঙ্গি, বল্লম ইত্যাদি নিয়ে ব্রিটিশ সরকার ও তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে শামিল হয়।উত্তরবঙ্গের সংগঠিত মানুষ ইংরেজ সরকারকে শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়।এদিকে সন্দীপের চরের বিদ্রোহ (১৭৬৯), রংপুর বিদ্রোহ (১৭৮৩), পাগলা পন্থীদের বিদ্রোহের মাধ্যমে উত্তরবঙ্গের মানুষ ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদের স্বপ্ন দেখতে থাকে।   

ব্রিটিশ বিরোধীতায় উত্তরবঙ্গের মানুষ যে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল সে কথা আগেই আলোচনা করেছি।সব ধরনের ব্রিটিশবিরোধী তাই উত্তরবঙ্গের সাধারণ মানুষ সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল এবং এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে।১৯০৫ সালে অ্যান্ডুজ ফ্রেজার, সচিব রিজলি ও লর্ড কার্জন বাঙালি জাতিকে দ্বিধাবিভক্ত ও দুর্বল করার জন্য বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
চলবে... 

লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী

আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।

ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com

লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।

ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top