কয়েক ঘণ্টা-কোয়েল দাস || ছোটগল্প || অকপট অনুসন্ধান

0


কর্মব্যস্ততার জীবন মণিকার।বাসে ট্রামে চড়ে অফিস যাওয়া,তারপর অফিসের কাজ আর অফিস শেষ করে অফিসের একগাদা কাজ নিয়ে বাড়ি ফেরা। বাড়ি ফিরে স্নান সেরে পরিচালিকা-তুলিকে চা দিতে বলে প্র্তিদিনের মতো আজও বসলেন অফিসের কাজ নিয়ে,কিন্তু আজ কেমন যেন একটু ক্লান্ত মনে হচ্ছিল মণিকাকে।জানলা খোলা,বাইরে ঝড়ের সাথে বৃষ্টি পড়েছে। বাইরের মনোরম পরিবেশ ক্লান্ত চোখ দুটিকে হাতছানি দিয়ে মনের স্মৃতির পাতাগুলো একবার খুলে দেখার জন্য ডাকছিল।মণিকা হাতের ফাইলটা বন্ধ করে দিয়ে টেবিলের উপর নামিয়ে,চেয়ারে মাথা হেলিয়ে দিল,বৃষ্টির ঠান্ডা হাওয়া আর ঝড়ের তান্ডবের সাথে মনটা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল।লোডশেডিং-এর জন্য অন্ধকার ঘরে বিদ্যুতের ঝলকের আলো মণিকার শরীরের উপর পড়ে, সাময়িক আলোকিত করছিল।অতীতের সেই দিনটা ঠিক এই রকমই ছিল অন্ধকার ঝড়-জলের রাত,শুধু পার্থক্য সময়ের……।জানলার সামনে মনে যত রাগ অভিমান আছে সবটুকু উজাড় করে বসে বসে কাঁদছিলাম।সেইদিন জয়েন্টএন্ট্রাস পরীক্ষা ছিল,ভালো হয়নি।যথাসম্ভব তৈরি হয়েছিলাম এই দিনটার জন্য।এই দিনটা কেন  জীবন থেকে আলো কেড়ে নিয়ে একরাশ অন্ধকার দিয়ে চলে গেলো। তাহলে কি ইঞ্জীনিয়ার হবার স্বপ্ন মুছে দেব?বাবার দেখানো তিলে তিলে গড়া স্বপ্ন এক দিনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাবে?এই কথাগুলি মনে করেছিলাম,আর কাঁদছিলাম।আমার একটা ‘না’ শব্দ আমাকে যতটা কষ্ট দেবে,তার থেকে অনেক বেশি কষ্ট দেবে বাবাকে।পরীক্ষা হল থেকে বেরিয়ে কি বলব ওই মানুষটাকে যে বাইরে দাঁড়িয়ে হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় গুনছে?আর ভাবছে আমার মনি ‘একটু হেসে’দূর থেকে ঈশারা করে বলবে পরীক্ষা ভালো হয়েছে।সময় শেষ, বাবা সিড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কিন্তু এখনো তো  আসছে না,কি হলো বাবার আদুরে মণির।সেই মুহূর্তেই মেয়ের ইঞ্জীনিয়ার হবার স্বপ্ন,আশা,সব ভুলে মনের মধ্যে এক কথা,হৃদস্পন্দনের প্রতিটি স্পন্দে বলতে লাগল মণি আমার কাছে ফিরে আয়।দূরে মণিকে দেখতে পেয়ে,কয়েক মুহূর্তের মধ্যের সমস্ত চিন্তা মুছে দিয়ে অস্ফুটনে বলে উঠলেন ওই আমার মণি আসছে।তিনি অনইচ্ছাকৃত বললেন-কি রে পরীক্ষা কেমন হল?অনেক উৎসুখের সঙ্গে আমার মুখ থেকে,“ভালো”উত্ত্টা শোনার জন্য দাঁড়িয়ে রইলেন।“না” বাবা, পরীক্ষা ভালো হ্য়নি।বাবা তখন ‘না’ শব্দটা শোনার জন্য প্রস্তুত না থাকলেও সেই সময়টা তাকে প্রস্তুত করে দিয়েছিল ‘না’ শব্দটার জন্য।সেই কয়েক সেকেন্ডে মনে হয়েছিল পৃথিবীটা থেমে গেল, সারা শরীরে কম্পনের মধ্যে বলে উঠল মণি পারল না।তারপরই হঠাৎ বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতো মনে হল, স্বপ্ন আমি দেখেয়েছি,বাস্তব করার দায়িত্বও আমার,মণি পারবে,এই ‘না’ শব্দটাই শক্তি করে তুলতে হবে,যেটা তাকে মনবল ও সাহস দেবে।

 এই সব কথা নিজের মনের মধ্যে বলে মণির দিকে তাকিয়ে –“সব কিছু ঠিক আছে”,বলে মণিকাকে বাড়ি নিয়ে চলে এলেন।আমার সঙ্গে বাবার আর কোন কথা হয়নি,কারণ মনকে শক্ত করতে সময় লেগেছিল,তিনি একজন পিতার হওয়ার জন্য,তাঁর দায়িত্ব নিজের মনের থেকেও তার মেয়ের মনকে শক্ত করাতে সহায্য করা।বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন –“চোখের জল মোছ,চল ছাদে গিয়ে বসি”।বৃষ্টি থেমে  গেছে অন্ধকার ছাদে চাঁদের আলো পড়েছে, ফুরফুরে হওয়া বেশ গায়ে লাগছে।আমি বলতে গেলাম-“বাবা আমি……” বাবা কথাটা থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন-“আজকের দিনটা শুধুই এক স্বপ্ন,যেটা তোর জীবনে ঘটেনি তুই শুধু অনুভব করেছিস মাত্র।জলভরা চোখে এক দৃষ্টিতে বাবার দিকে চেয়ে রইলাম।যেটা ঘটেছে, সেটা ধরে বসে না থেকে,ওখান থেকে শিক্ষা নিয়ে,জীবনের পথে এগিয়ে যেতে হবে,জীবনে ওঠা-পড়া হবেই,সবটা বাড়ির মসৃণ উঠান হবেনা রে,ইঞ্জীনিয়ার তোকে হতেই হবে।চারিদিক যখন হতাশায় ভরে যায়,জীবন শূন্য বলে মনে হয়,সব কিছু নিরাশ করে,তখন মনেরজোর সাফল্যকে,সেই পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে দেয়,যেটা স্বপ্নেও কল্পনা করিসনি,যে তুই সেই চূড়ায় কোন দিন পৌঁছাতে পারবি।একজন নারীই পারে,যে শত পুরুষের সঙ্গে সমযোগ্যাতায় লড়াই করে, জয়ী হয়ে ফিরে আসতে।দেখিসনি,পুরানের যুগে এত শক্তিশালী আসুরদের বধ করতে একজন নারীকেই সৃষ্টি করা হয়েছিল।নারী যখন সংঞ্জা হারায়,সে তখন শঙ্কর হয়ে যায়”।তখন বাবার গলাটা গম্ভীর হয়ে গেল।অবুঝের মতো মৃদু স্বরে বললাম-“সংঞ্জাহীন হয় মানে…,” “নারী যখন বুঝতে পারে,আমি বা আমার জন্ম হয়েছে ওই দরজার আড়ালে লুকিয়ে থেকে সবার সম্মতি নিয়ে ঘোমটা আড়ালে থেকে হ্যাঁ বলার জন্য নয়, শত্রুদের সামনে দাঁড়িয়ে চোখে-চোখ রেখে তাদের সঙ্গে লড়াই করার জন্য,সে তখন শঙ্কর হয়ে,ধ্বংস করে দিতে পারে সব”।বাবার প্রতিটি কথা মনের ভিতরের হতাশাকে দূর করে শক্তি জাগিয়ে তুলছিল।বাবার গম্ভীর কথা শুনে বললাম-“বাবা,নারী যদি পুরুষের থেকে এত শক্তিশালী,তাহলে আমাদের দেশের অস্যংখ্য নারী কেন পুরুষের দ্বারা নির্যাতিত এবং নিপীড়নের স্বীকার?” “কারণ একটা অসুর মরলেও শতশত জন্মাচ্ছে। নারী পুরুষের থেকে এত শক্তিশালী, এই কথাটা মিথ্যে পরিণত করার জন্য”।তাহলে বাবা,“ওই সব নির্যাতিত, নিপীড়িত মেয়েরা “সংঞ্জাহীন” হয়ে শঙ্কর হয়ে উঠছে না কেন?” একটু হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বাবা বললেন-“তাদের পাশে মনবল দেবার মত,তাদের কোন লোক নেইরে মা।এই সব কথা ছাড়াও একটা কথা কখনই ভুলবি না…আমাদের বসুমাতাও কিন্তু একজন নারী”।আমার মধ্যে অন্ধকার সরে গিয়ে আলো ফুটে উঠছিল,যেন নিজেকে চিনতে পারছিলাম।আবার প্রশ্ন করলাম- “তাহলে ভূ-মাতা শিক্ষা দিচ্ছে না কেন?” বাবা খুব কোমল কণ্ঠে উত্তর দিলেন–“না রে, সে যে সবার আগে একজন ‘মা’।আর একজন ‘মা’ যে তার সন্তানের শত অন্যায়ের সত্ত্বেও সব ক্ষমা করে,তাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে চায়।সে বিশ্বপুরুষের কাছে,এই একটি বিষয়ে খুব অসহায়।পুনরায় ধুলো ঘাটবে জানার সত্ত্বেও মা যেমন তার সন্তানকে ধুলো ঝেরে কোলে তুলেনেয়,ঠিক তেমনি বিশ্বমাতা নিজে নারী হয়েও,নারী নির্যাতন সব সহ্য করে সন্তানকে আড়াল করতে চান,একজন বিশ্ব-প্রকৃতির মা বিশ্বপিতার কাছে।তারপর সে একজন নারী,যে মনে করলে,বিশ্বকে ধ্বংস করে,নতুন করে সৃষ্টির রূপ দিতে পারে।নারীর অস্মান নিশ্চিত মৃত্যু”।তখন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম-“চোখের জল আর নয়, আমি পারবো স্বপ্ন পূরণ করতে,আমি বুঝেছি যেখানে কিছু থাকেনা,সেখানে থাকে মনের জোর।নিজে নিজে না হেরে গেলে কেউ কোন দিন হারাতে পারবে না।সব সময় তৈরি থাকতে হবে, একটা প্রশ্ন নয়, সবার সমস্ত প্রশ্নের উত্তরের জন্য”।চোখের জল মুছে উঠে দাঁড়িয়ে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার সঙ্গে বললাম- “হ্যাঁ আমি পারব, সেই সব নারীদের মধ্যে একজন হতে, যারা একহাতে সৃষ্টিকে বিনাশ করতে যেমন পিছু পা হয় না, তেমনি অন্য হাতে সৃষ্টিকে এমন সুন্দরভাবে গড়ে তোলে যেন, রং তুলি দিয়ে কেউ এঁকে দিয়েছে”।

 বাবার মনের মধ্যে ধ্বনিত হচ্ছিল মণি এরপরের বার পরীক্ষাতে সফল অবশ্যই হবে ‘না’যত কঠিন,শক্ত,বিরক্ত, বিস্বাদ, হোক না কেন,মণি সেটাকে ভেঙে বেরিয়ে আসতে পারবে। সেই সন্ধ্যাটা যেন এক অসাধারণ সময় ছিল,যেটা আমাকে গরম,নরম লোহা থেকে শক্ত আর শীতল লোহায় পরিণত করেছিল।অসহায় ও দুর্বল মনকে শক্তিশালী করে তুলেছিল।সেই দিনের কয়েক ঘণ্টা আমার জীবন ও ভবিষ্যৎ-কে এই ভাবে বদলে দেবে  আমি কখনো ভাবেনি।বাবার স্বপ্ন পূরণ করে সরকারি ইঞ্জীনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলাম,শুরু হল অন্য জীবন।ছেলেদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নতুন পথ চলা শুরু।কলেজ শুরুর প্রথম দিকে রেগিং নামক মানসিক পীড়নের স্বীকার হতে হয় ,আমিও তার ব্যাতিক্রমী নই ।তখন পরিচয় হয় বিমলেন্দ্রর সঙ্গে চোখে-চোখে আলাপ তারপর বিশেষ বন্ধুত্ব, সময়ের সাথে পরিণতি পায় প্রেমের সম্পর্কে।আবেগের বসে আমরা দুইজনে বিমলেন্দ্রের বাড়িতে উপস্থিত হই।বিমলেন্দ্রের মা অমানবিকভাবে আমার কালো রূপের চর্চা করেন।সেইদিন বিমলেন্দ্র তার মাকে বুঝানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু কোন  লাভ হয়নি তাই চুপ করে সব শুনে মায়ের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।ওর মা বুঝতে চাইনি,আমাদের ভালোলাগা ভালোবাসার কথা। আমাকে একা অসহায় অবস্থায় ফিরতে হয়েছিল।চোখের রঙিন প্রেমের স্বপ্ন ঢেকে যায় ফিট সাদা কাপড়ের আড়ালে।এই ঘটনাটা বাবার চোখকে ফাঁকি দিতে পারেনি।আমার মুখের ভাবভঙ্গি,চোখের ঈশরাতেই বুঝেছিলেন পথভ্রষ্ট পথিক পথে ফিরেছে।এই সব কথা মনে করতে করতে চায়ের কাপে চুমুক দিল মণিকা।বৃষ্টির ঝিটের সঙ্গে ঠান্ডা হাওয়া মনকে আরও উদাস করে দিচ্ছিল।আজ আফিস যাওয়া সময়  বিমলেন্দ্রকে দেখলাম আমি কাছে যেতেই ও কোথায় ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে গেল।আজ ওর উপর আমার কোন অভিমান নেই।শুধু একটা কথা বলার ছিল-ভাল থাকাটা বড় কথা যেটা রূপ দিয়ে বিচার করা যায় না।যাইহোক সেই সময় বাবা একটা কথা বলেছিলেন-অতীতকে ধরে বসে না থেকে, সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে,ভুলে যাও।ভালো অতীতটা নিয়ে আনন্দে থাকো।এখন আমি সফল ইঞ্জীনিয়ার।সেই খারাপ অতীতটাই এখন কতগুলি শব্দ আর একটা পেন দিয়ে গল্প হয়ে গেছে,যেটা মণিকার জীবনের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠছে……।হাত থেকে চায়ের কাপটা নামিয়ে আলতো ভাবে চোখ বুঝলো মণিকা।ফোনটা বাজতে দেখে তুলি বলল-দিদিমণি আপনার ফোন মণিকা অস্ফুটনে বলল বাবা হয়তো………।  



লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী

আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।

ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com

লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।

ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।





একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top