উত্তরবঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলন-ডঃ সমিত ঘোষ || দ্বিতীয় পর্ব || প্রবন্ধ || অকপট অনুসন্ধান

0

প্রথম পর্বের পর... 
বড়লাট কার্জন বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব কার্যকর করার জন্য এই যুক্তি প্রদর্শন করেন যে বাংলার মতো বিরাট প্রদেশের শাসনভার একজন গভর্নরের হাতে নাস্ত রাখা মোটেই সমীচীন নয়।সুতরাং শাসনকার্যের সুবিধার জন্য বাংলাকে দু'ভাগে করা উচিত।স্থির হয় যে পশ্চিমবঙ্গ, উড়িষ্যা ও বিহার নিয়ে একটি এবং আসাম পূর্ববঙ্গ ও উত্তরবঙ্গ নিয়ে একটি প্রদেশ গঠিত হবে।এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।জাতীয়তাবাদী সচেতনতায় সেদিন উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল উত্তরবঙ্গের জনমানস।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে উত্তরবঙ্গের কথা বলতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় জলপাইগুড়ির কথা।জলপাইগুড়িতে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন কে কেন্দ্র করে এক অদ্ভুত উন্মাদনা লক্ষ্য করা যায়।বিদেশি বস্ত্র বর্জনের জন্য জলপাইগুড়ির  দিনবাজারে  বিলাতি কাপড় পড়ানো হয়েছিল।এই ঘটনায় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়।বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদ করতে গিয়ে দুর্গাদাস চক্রবর্তী, অন্নদা বিশ্বাস, আদ্যনাথ  মিশ্র প্রমুখরা ধরা পড়েন ও তাদের দুই সপ্তাহ কারাবাস ভোগ করতে হয়।কিন্তু চন্ডী চক্রবর্তী ও প্রিয়নাথ গোস্বামী পালিয়ে যান।জেল থেকে খালাসের দিন যোগেশচন্দ্র ঘোষের নেতৃত্বে একদল তরুণ পুলিশকে একরকম চ্যালেঞ্জ করে।এ ঘটনায় জলপাইগুড়ির প্রশাসনিক স্তরে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়।এভাবে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে জলপাইগুড়িতে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রবল বেগে প্রবাহিত হয়।

দেশীয় রাজ্য কোচবিহারেও  বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের উন্মাদনা লক্ষ্য করা যায়।এখানকার বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অন্যতম রূপকার কাশী মোহন ঘোষ।তিনি ১৯০৫ সালে ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়তেন।স্বদেশিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়েই তিনি পড়া ছেড়ে অ্যান্টি সার্কুলার সোসাইটিতে নাম লিখিয়ে স্বদেশী প্রচারে আত্মনিয়োগ করেছিলেন।বঙ্গভঙ্গের সময় কোচবিহারে কিছু 'আখড়া' তৈরি হয়েছিল।এই আখড়াগুলিতে যুবকেরা লাঠি খেলা ও ছোরা খেলা শিখতো।রাজপরিবারে গৃহশিক্ষক অশ্রুমান দাশগুপ্ত ছাত্রাবস্থায় নতুন বাজারে  এরকম একটি আখড়ায় যেতেন  বলে উল্লেখ করেছেন।জেলা শহর কোচবিহার এবং মাথাভাঙ্গাতেও অনুশীলন সমিতির শাখা ছিল।বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে কোচবিহারের গণআন্দোলন গড়ে ওঠে।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন দার্জিলিঙেও ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।নেপালি সম্প্রদায়ের মানুষ ও ব্রিটিশের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তে ধিক্কার জানিয়েছিল।দার্জিলিংয়ের খগেন্দ্র রায় নামে এক বাঙালি যুবক কো-অপারেটিভ স্টোর খুলেছিলেন।অন্যান্য টি-এস্টেটও ঐ যুবকের কার্যকলাপে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল।  

মালদহের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে ব্যাপক সাড়া পাওয়া গিয়েছিল।মহম্মদ নূর বক্সের নেতৃত্বে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়।মালদহের ছাত্রসমাজ এগিয়ে আসে।হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সেদিন ফুলার সাহেবকে মালদহে ধিক্কার জানিয়েছিল।এই সময় মালদহে অনেক জাতীয় বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।

বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সমগ্র দিনাজপুর উত্তাল হয়ে ওঠে। দিনাজপুরে মহারাজার  নেতৃত্বে ১৯০৫ সালের ২১ শে জুলাই এক  জনসভা হয়।ঐ সভায় লালমোহন ঘোষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কর্মসূচির কথা ঘোষণা করেন।

দিনাজপুরের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন যোগীন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তী, গিরিনাথ রায় বাহাদুর,  রাখাল চন্দ্র সেন,  মধুসূদন রায়,  মাধব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়,  গোপাল চন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, ললিত চন্দ্র সেন প্রমূখ।ঐ আন্দোলনের ঢেউ পশ্চিম দিনাজপুরেও (বর্তমান উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর) পড়েছিল।উত্তর দিনাজপুরের মানুষ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে।জেলা শহর রায়গঞ্জের উকিল কুলোদা কান্ত ঘোষ  আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।কুলদাবাবুর নেতৃত্বে রাজবাড়িতে সে দিন অরন্ধন দিবস পালিত হয়।হাজার হাজার মানুষ গণ-অনশনে যোগ দেয়।

দক্ষিণ দিনাজপুরের জেলা শহর বালুরঘাটের শহর এবং গ্রামাঞ্চলের বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী আন্দোলন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।বালুরঘাটে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।এই জনসভায় সভাপতিত্ব করেন ড: চন্দ্রকান্ত চট্টোপাধ্যায় মহাশয়।জনসভায় বিলেতি পণ্য বয়কটের প্রস্তাব গৃহীত হয়।বঙ্গভঙ্গ রদের জন্য প্রস্তাব গৃহীত হয়।সেদিন জনসভায় ব্রিটিশ বিরোধী বক্তব্য রাখেন নলিনীকান্ত অধিকারী, দেবেন্দ্র গতি রায় প্রমুখরা।এই সময় স্বদেশী ভান্ডার খোলা হয়।সকলের সহযোগিতায় সেদিন সেই স্বদেশী ভান্ডার পূর্ণ হয়েছিল।

বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে বালুরঘাটে ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর অরন্ধন দিবস পালিত হয়।নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কার্জনের বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে ও প্রতিবাদে সামিল হয়।

বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের পর গৌড়বঙ্গসহ সমগ্র উত্তরবঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলন এক ভিন্ন রূপ পায়।বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভ, বিদ্রোহ, সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে।উত্তরবঙ্গ জুড়ে ব্রিটিশরাজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলন শুরু হয়।   
১৯০৭ সালে উকিল দুর্গাচরণ সান্যাল হিলি স্টেশনে দুই ইংরেজকে জখম করেন।ফলে তাকে হাজতবাস করতে হয়।দুর্গাচরণবাবুর গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে তখনকার দেশীয় পত্র-পত্রিকা গুলি সরব হয়ে উঠেছিল।জলপাইগুড়ির বিপ্লবী বীরেন দত্তগুপ্ত ১৯১১ সালে কলকাতা হাইকোর্টের ভেতরে সি আই ডির  সুপারিনটেন্ডেট  শামসুল হককে হত্যা করেন।বিচারে তার ফাঁসি হয়।উত্তরবঙ্গের একজন অন্যতম স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন কালকেতু বা কেতু বোস। তার পোশাকি নাম সরোজকুমার বসু।তিনি ছিলেন বিপ্লবী গুপ্ত সমিতির সক্রিয় সদস্য।তাকে স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে বিপ্লবী বিভূতি গুহ  ও বরদাকান্ত চক্রবর্তী মহাশয়।সরোজ বসু ছিলেন দিনাজপুরের একজন মূল সংগঠক।রায়গঞ্জে ফিরে সেখান থেকেই  ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন চালাতে থাকেন তিনি।১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে কেদার চক্রবর্তীর নেতৃত্বে তপনে ছত্রিশা  আন্দোলন শুরু হয়।পরে সুরেন্দ্রনাথ বাগচী ও সুরেশ চন্দ্র চ্যাটার্জি এই আন্দোলনে যোগ দেন।নদী,  বিল, দিঘী এসবই প্রজাদের সম্পত্তি এরই ভিত্তিতে ছত্রিশা  আন্দোলন গড়ে ওঠে।দিকে দিকে জমিদার,  জোতদার,  মহাজন ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠতে থাকে।

১৯২১-১৯২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দক্ষিণ দিনাজপুরে কংগ্রেসী আন্দোলন ও বিপ্লবী আন্দোলন বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে।ফাল্গুনী মিত্র, মন্মথ রায়, প্রজাপতি চ্যাটার্জী, মদন বাগচি, নরেশ ব্যানার্জি, কালা মিত্র, ষষ্ঠী ঘোষ, ফেলা গুহ, গিরীজা দাস, সুকুমার দাস প্রমুখরা 'হিতসাধন মন্ডলী' প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন।১৯২৭ সালের শেষে 'চোদ্দ মৌজা প্রজাবিদ্রোহ '-এর সূচনা হয়।১৯২৪-৩২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ট্যাক্স বন্ধ আন্দোলন শুরু হয়।   

১৯৩৩ সালের ২৮শে অক্টোবর ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ দিন। সেদিন প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একদল যুবক হিলি রেল স্টেশনে জমায়েত হয়ে ইংরেজ কর্মচারীদের আক্রমণ করে, তাদের ওপর গুলি ও বোমা বর্ষণ করে এবং সমিতির অর্থ সংগ্রহের জন্য ডাকাতি করে।ওই দলের একজন সদস্য ছিলেন রায়গঞ্জের সরোজ কুমার বসু।তাছাড়া সেদিন তার সঙ্গী হয়েছিলেন সত্যব্রত চক্রবর্তী,  হৃষিকেশ ভট্টাচার্য্য,  আব্দুল কাদের চৌধুরী,  কিরণ চন্দ্র দে, প্রফুল্ল নারায়ণ সান্যাল,  হরিপদ বসু প্রমুখরা।হিলি ডাকাতির বিচারে শাস্তি হয় এইরকম:

১। প্রাণকৃষ্ণ চক্রবর্তী ও হৃষিকেশ ভট্টাচার্য্য- প্রথমে ফাঁসির আদেশ রদ হয় পরে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর।
২। সত্যব্রত চক্রবর্তী ও সরোজ কুমার বসু- প্রথমে ফাঁসির আদেশ রদ হয় পরে ১০বছর সশ্রম কারাদণ্ড।
৩। প্রফুল্ল নারায়ণ সান্যাল ও আবদুল কাদের চৌধুরী- যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর।
৪। কিরণ চন্দ্র দে- প্রথমে যাবজ্জীবন, পড়ে ৫ বছর সশ্রম কারাদণ্ড।
৫। হরিপদ বসু ও রামকৃষ্ণ সরকার- প্রথমে ১০ বছর পরে ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড।
৬। বিজয় চক্রবর্তী - ১০ বছর।  
  (সূত্র জাগরণ ও বিস্ফোরণ, দ্বিতীয় খন্ড/ কালীচরণ ঘোষ)
১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে ২৭ শে অক্টোবর হিলি মেইল ডাকাতির পর ধরা পড়ে যাওয়া দুই বিপ্লবী পুলিশের চাপে বালুরঘাটের বাসা থেকে B.C.L.A  Act - এ গ্রেপ্তার হন।  

১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে ১৩ ই জুলাই বালুরঘাটের বোল্লা গ্রামে প্রণবেন্দু চৌধুরীর বাড়ি ডাকাতি হয়। অনেকে বলেন গোবিন্দ ঘোষের (মুকুন্দ) নেতৃত্বে এই ডাকাতির অর্থ হিলি ডাকাতির মামলার খরচ চালানোর জন্য পাঠায়।হিলি ডাকাতির আপিলের রায় বেরোয় ৬ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪।
দার্জিলিংয়ের বিপ্লবী ক্রিয়া-কলাপত্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে।এর প্রধান সংগঠক ছিলেন বাঘাযতীন। বারীন ঘোষ ও প্রফুল্ল চাকীর সহায়তায় দার্জিলিঙে বাংলার গভর্নর অ্যান্ডু ফ্রেজার কে হত্যার পরিকল্পনা করেন চারুদত্ত।১৯৩৪ সালের ৮ই মে দার্জিলিঙে বাংলার গভর্নর জন অ্যান্ডারসন কে হত্যার চেষ্টা করেন ভবানী ভট্টাচার্য ও রবীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, কিন্তু তারা ব্যর্থ হন। বিচারে ভবানী ভট্টাচার্যের ফাঁসির হুকুম হয় এবং রবীন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়ের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়।

চলবে...



লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী

আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।

ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com

লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।

ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top