দ্বিতীয় পর্বের পর...
ব্রিটিশ সরকার, মহাজন, জোতদার, নায়েব-গোমস্তাদের অত্যাচারে উত্তরবঙ্গের মানুষ অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে।এরফলে আধিয়ার, কৃষক, শ্রমিক, আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ সকলেই ঐক্যবদ্ধভাবে ইংরেজ বিরোধিতা শুরু করে।
এক সময় সিধু-কানু, চাঁদ-ভৈরবের নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ,বিরসা মুন্ডার নেতৃত্বে মুন্ডা বিদ্রোহ, বুদ্ধ ভগত ও জোয়া ভগতের নেতৃত্বে কোল বিদ্রোহ ঘটেছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে।ঠিক সেই রকমভাবেই পরবর্তীকালে মালদহের জিতু সাঁওতাল, দিনাজপুরের কাশীশ্বর চক্রবর্তী,খাঁপুরের চিয়ার সাই শেখ,জলপাইগুড়ির আব্দুল্লাহ রসূল,নন্দকিশোর বর্মন,দার্জিলিংয়ের লাডেনলা, শিলিগুড়ির ব্রজেন্দ্রনাথ বসু রায়, চারু মজুমদার, কোচবিহারের পঞ্চানন বর্মা ও জীবন দে প্রমুখরা সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে তাদের আন্দোলন, বিক্ষোভ, বিদ্রোহ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।
স্বাধীনতা আন্দোলন বালুরঘাট, দক্ষিন দিনাজপুর Image Source: Internet
১৯২০-১৯৩১, এই সময়ের মধ্যে স্বাধীনতা আন্দোলন উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।১৯১৯-১৯২২,এই বছর গুলিতে ভারত তথা উত্তরবঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলন এক নতুন মাত্রা পায়।রাউলাট আইন,জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনা, খিলাফৎ আন্দোলন,সত্যাগ্রহ -এসব ঘটনা উত্তরবঙ্গের মানুষকেও নাড়া দেয়।
জালিয়ানওয়ালাবাগ , Image Credit By Soumen Das
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, Image Source: Museum Jallianwala Bagh
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, Image Source: Museum Jallianwala Bagh 2
১৯২০ সালে দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে উত্তরবঙ্গেও তার প্রভাব পড়ে। কোচবিহারের মহারাজা যখন জিতেন্দ্র নারায়ন, তখন অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ কোচবিহারের ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রদের মধ্যেও উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। কোচবিহারের রাজ কর্তৃপক্ষ ও ব্রিটিশ মিলে দমনমূলক নীতি গ্রহণ করা সত্ত্বেও অসহযোগ আন্দোলন কোচবিহারের শহরে ও গ্রামাঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছিল।রাজ্যের হাটগুলি ছিল আন্দোলনের প্রচারের মূল কেন্দ্র।রাজ সরকার সর্বত্রই ১৪৪ ধারা জারি করেছিল।দিনহাটা, সিতাই এইসব অঞ্চলে ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল অসহযোগ আন্দোলন।
তেভাগা আন্দোলন, উত্তরবঙ্গ, Image Source : Internet
মহারাজা জিতেন্দ্র নারায়ণের মৃত্যুর পর মহারানি ইন্দিরা দেবী Regent হিসেবে দীর্ঘ ১৪ বছর (১৯২২-১৯৩৬) রাজ প্রশাসন পরিচালনা করেছিলেন।এ সময়ের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো ব্রিটিশ ভারতের আইন অমান্য আন্দোলন।কিন্তু সতর্ক রাজ প্রশাসন ও ব্রিটিশ দমননীতির ফলে আইন অমান্য আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেনি।কোচবিহারে এসেছিলেন বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম,মুকুন্দ দাস, অরবিন্দের বড় ভাই বিনয় কুমার ঘোষ প্রমুখরা।এদের পদার্পণে কোচবিহারের স্বাধীনতা আন্দোলন বলিষ্ঠ রূপ নেয়।
তেভাগা আন্দোলনের স্মারক, বালুরঘাট, দক্ষিন দিনাজপুর Image Credit By Soumen Das
জলপাইগুড়িতে ১৯২২ সালে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ স্বরাজ্য পার্টির প্রচারে অংশ গ্রহণ করেন।এর দু'বছর পর তিনি আবার জলপাইগুড়ি আসেন।দেশবন্ধুর আগমনে জলপাইগুড়ির স্বাধীনতা আন্দোলন এক নতুন মাত্রা লাভ করে।দেশবন্ধু রায়কত পাড়ার রায়কত বাড়ির বিস্তীর্ণ মাঠে হাজার হাজার মানুষের সামনে এক আবেগদীপ্ত ভাষণ দেন।দেশবন্ধুর বক্তৃতা শুনে গনেশ সান্যাল আইন ব্যবসায়ে ইস্তফা দেন।জগদিন্দ্রদেব রায়কত 'অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের'র পদে ইস্তফা দেন।ড: চারুচন্দ্র সান্যাল গবেষণার কাজ ছেড়ে কংগ্রেসের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এছাড়া যোগেশ দত্ত, সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র,বীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য, বীরেন দত্ত, হিরণ্যকান্তি বসু প্রমুখরা অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেয়।
জেলার সর্বত্র কমবেশি অসহযোগ আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠে।বোদা থানার মন্মথ দত্ত, ভোলা মজুমদার, দেবানন্দ রায়, শিবকান্ত রায়, তেতুলিয়ার নিত্যানন্দ দাস, পার্থগ্রামের কেশব দত্ত, আলিপুরদুয়ারের রসিক গাঙ্গুলী প্রমুখরা নিজ নিজ এলাকায় আন্দোলন পরিচালনায় দায়িত্বে ছিলেন।আলিপুরদুয়ারের প্রান্তীয় জনপদে অসহযোগ আন্দোলন গণআন্দোলনের রূপ নেয়।উত্তরবঙ্গের অন্য কোনো জেলার গ্রামীণ জনপদে অসহযোগ আন্দোলন এত তীব্র রূপ হয়নি।কংগ্রেস এখানে খাজনা বন্ধ আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল।এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নানা গান রচিত হয়েছিল।যেমন-
“ভাত দিস, পানি দিস, খাজনা দিস না।
জান দিস, পান দিস, ট্যাক্সও দিস না,
ইংরেজের খাজনা দিস না।
বিলাতি কাপড়া পড়াশুনা
হাট বন্ধ কুলকুলি
বন্দেমাতরাম হামার বুলি।"
আইন অমান্য আন্দোলন, Image Source: Internet Wikipedia
এইসময় বিজয়া দশমীর দিন প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় নৌকা থেকে স্লোগান উঠলো 'বিলেতি জিনিস বয়কট কর','মাদক দ্রব্য বর্জন করো', 'অস্পৃশ্যতা দূর কর' এসব প্রচারের ফলে পুলিশি অত্যাচার বাড়লো।রাজদ্রোহের অপরাধে বীরেন দত্ত, চারুচন্দ্র সান্যাল, চুনিলাল বসু, যতীন রায়, অনিল বাগদি প্রমুখের গ্রেপ্তার হন। ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দে আইন অমান্য আন্দোলন জেলাতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য আন্দোলনকারী গ্রেপ্তার হন।অনেক স্বাধীনতা সংগ্রামীকে বক্সা ফোর্টে কারারুদ্ধ করে রাখা হয়। ব্রিটিশ সরকার জেলার সীমান্ত অঞ্চলের ভুটান পাহাড়ের পরিত্যক্ত বক্সা ফোর্ট সংস্কার করে বন্দী নিবাসে পরিণত করে।
লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী
আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।
ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com
লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।
ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।









