নারী-সাংবাদিকতায় পথিকৃৎ কবিতা সিংহ -পূরবী বসু
বিংশ শতকের তৃতীয় দশকে বাংলাকে আলোকিত করতে যেসব ক্ষণজন্মা সৃজনশীল মানুষ এই মাটিতে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে এক অসামান্য নারী—যিনি সর্বার্থেই ছিলেন এক ব্যতিক্রমী মানুষ—তিনি প্রখ্যাত গল্পকার, ঔপন্যাসিক, কবি ও সাংবাদিক কবিতা সিংহ (১৯৩১-১৯৯৮)।
সবচেয়ে বড় কথা, চিন্তায়, চেতনায়, কাজকর্মে, পোশাকে, জীবনযাপনে, পেশা-নির্বাচনে এবং সামগ্রিক জীবনধারণে তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই আধুনিক নারী।
কবিতা সিংহের বিখ্যাত কবিতাগ্রন্থ ‘হরিণা বৈরী’-র ‘মহাশ্বেতা’ নামক কবিতায় তিনি সমাজসচেতন কথাসাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবীকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে লিখেছিলেন—মহাশ্বেতা দেবী তাঁর সময়ের বহু আগে পৃথিবীতে চলে এসেছেন। মহাশ্বেতাকে যে প্রশ্ন করেছিলেন কবিতা, আমরাও সেই একই প্রশ্ন কবিতাকেও করতে পারতাম—
“তুমি কেন তিনশ’ বছর আগে এই ভুল পৃথিবীতে এলে?”
তিনি নিজেও জানতেন, তাঁর সমসাময়িক লেখক ও সাংবাদিকদের তুলনায় তিনি অনেক বেশি অগ্রগামী ছিলেন—সময়ের আগেই পৃথিবীতে এসেছিলেন এবং পরবর্তীকালে ক্রমে হয়ে উঠেছিলেন আধুনিক কর্মজীবী সৃজনশীল নারীর এক উজ্জ্বল মডেল।
সম্প্রতি নতুন করে কবিতা সিংহকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে প্রমিতী ভৌমিক লিখেছেন (কালি ও কলম, নভেম্বর ২০১৫) —
“এক অদ্ভুত আত্মপ্রত্যয় ছিল তাঁর স্বরে। সমাজের এক প্রস্থবদ্ধতাকে ভাঙতে চেয়েছিলেন তিনি। কল্পনা করেছিলেন এক নতুন ভবিষ্যতের। শ্রেণি, বর্ণ, লিঙ্গ নির্বিশেষে ব্যক্তিসত্তার জাগরণ তিনি আকাঙ্ক্ষা করেছিলেন।”
কবিতা সিংহকে বাংলার নারীবাদী রচনার অন্যতম স্রষ্টা হিসেবে গণ্য করা হয়। আধুনিক কবিতায় নারীবাদের সূচনা তাঁর মাধ্যমেই হলেও তিনি কখনো ‘মহিলা কবি’ হতে চাননি—তিনি কেবলই কবি হতে চেয়েছিলেন।
তিনি মূলত কবি হলেও ছিলেন শক্তিশালী গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। একই সঙ্গে তিনি উপমহাদেশের অন্যতম পথিকৃৎ নারী-সাংবাদিক। তখন সাংবাদিকতায় পুরুষের পাশাপাশি উচ্চপদে মেয়েদের উপস্থিতি ছিল প্রায় নেই বললেই চলে। সেই হিসেবে সমগ্র বাংলায় কবিতা সিংহকে প্রথম প্রজন্মের পেশাদার নারী সাংবাদিক বলা যায়।
শুধু খবরের কাগজ বা সাময়িকী নয়, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়—তখনকার দিনের বেতারসংস্থা আকাশবাণী—তেও তিনি দায়িত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। টেলিভিশন তখনও বাজারে আসেনি। তাই সংবাদ, সাহিত্য, সংগীত ও নাটক প্রচারের প্রধান মাধ্যম ছিল বেতার এবং প্রিন্ট মিডিয়া।
সাহিত্যে তিনি গদ্য ও পদ্য—উভয় ধারায়ই সমান দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে—সাহিত্য ও সাংবাদিকতার বিষয়বাছাই, উপস্থাপন, কর্মজীবন নির্বাচন বা সাধারণ জীবন-যাপনের ক্ষেত্রেও—তিনি সমাজে নারীর দুরবস্থা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং তা তুলে ধরেছেন। পরবর্তীকালে তাঁরই উত্তরসূরি হিসেবে নবনীতা দেব সেন, মন্দ্রাক্রান্তা সেন, মল্লিকা সেনগুপ্ত প্রমুখ নারী লেখকরা নারীর বঞ্চনা, অবহেলা ও অসহায়তার প্রসঙ্গ সাহসের সঙ্গে লিখতে পেরেছিলেন।
নবনীতা দেব সেন তাঁর স্মৃতিচারণে লিখেছেন—
“কফি হাউসের দরজায় দীপশিখার মতো উজ্জ্বল এবং সহজ-সুন্দরী কবিতা সিংহকে প্রথম দেখার মুহূর্ত থেকেই যে বিশেষ শ্রদ্ধার চোখে দেখেছিলুম, সে চোখ আর কখনো বদলায়নি… আজকের নারীবাদিনীদের চেয়ে অনেক ক্রোশ বেশি পথ হাঁটতে হয়েছিল তাঁকে। আর এগিয়েছিলেন যোজন যোজন। জীবন তাঁর সরল ছিল না—না ঘরে, না কর্মক্ষেত্রে। হবে কী করে, কবিতাদি যে রণরঙ্গিনী!”
জন্ম, শৈশব ও সাহিত্যজীবনের শুরু
কবিতা সিংহের জন্ম কলকাতার ভবানীপুরে—১৬ অক্টোবর, ১৯৩১।
ছয় বছর বয়স থেকেই তিনি লিখতে শুরু করেন। তাঁর মা অন্নপূর্ণা সিংহ—যিনি কবিতার তুলনায় মাত্র ১৫ বছরের বড়—তাঁরই অনুপ্রেরণায় কবিতা লেখার ও ছবি আঁকার শুরু।
১৯৪৬ সালে, মাত্র ১৫ বছর বয়সে, দ্য নেশন পত্রিকায় প্রথম তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয়—ইংরেজিতে।
১৬ বছর বয়সে আনন্দবাজার-এ ‘আর্ট ও নারী’ শিরোনামে বিজ্ঞাপনে নারী-শরীরের ব্যবহার নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ লেখেন।
২৩ বছর বয়সে তিনি দু’বছর কাজ করেন ইংরেজি চলচ্চিত্র সাপ্তাহিক Cine Advance-এ, মেয়েদের পাতা সম্পাদনা করতেন। তাঁর কাজ ছিল গ্ল্যামারাস চিত্রতারকার ছবি-সহ রচনা লেখা।
১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয় আধুনিক দাম্পত্যের জটিলতা নিয়ে বিখ্যাত মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস ‘পাপপুণ্য পেরিয়ে’—যা কলেবরে ছোট হলেও সময়ের উপন্যাস সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
ব্যক্তিগত জীবন ও সংগ্রাম
পরিবারের সবার অমতে মাত্র বিশ বছর বয়সে সহপাঠী বিমল রায় চৌধুরীকে বিয়ে করেন তিনি। বিমল পত্রিকা সম্পাদনা ছাড়াও গল্প লিখতেন।
অর্থাভাবে সংসারের প্রয়োজন মেটাতে হিমশিম খেতে হতো। ফলে বিমলের গল্প লেখা বন্ধ হয়ে যায়। আর কবিতা সিংহ সক্রিয়ভাবে কর্মসংস্থানের জন্য বিভিন্ন পেশা গ্রহণ করেন—সাংবাদিকতা, রেডিও, শিক্ষকতা, কেরানিগিরি—যা পেয়েছেন, করেছেন।
সঙ্গে চালিয়ে গেছেন পড়াশোনা ও লেখালেখি। স্বামী বিমলের উৎসাহ ছিল তাঁর সাহিত্যযাত্রার বড় প্রেরণা। তাঁদের দুই কন্যা। এক কন্যার বোস্টনের বাসাতেই ১৯৯৮ সালে তাঁর মৃত্যু হয়।
নারী-অবান্ধব কর্মক্ষেত্রে সংগ্রাম
তখনকার দিনের সংবাদপত্র অফিসে মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট পর্যন্ত ছিল না। দিনের পর দিন, রাতের পর রাত পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে একই পরিবেশে কাজ করতে গিয়ে কী অসুবিধা হতো—আজকের সময়ে তা কল্পনাও করা যায় না। কিন্তু কবিতা সিংহরা সেই কঠিন পরিবেশেও মুখ বুজে কাজ করেছেন—আর তার প্রতিফলন এসেছে তাঁর সাহিত্যে।
সাহিত্যকর্ম
পঞ্চাশের দশকের এক গুরুত্বপূর্ণ কবি তিনি। তাঁর কবিতার বিষয়, ভাষা, প্রকাশভঙ্গি—সবই ছিল স্বতন্ত্র।
কবিতার বই তিনটি—
-
সহজসুন্দরী (১৯৬৫)
-
সপ্তদশ অশ্বারোহী (১৯৭৬)
-
হরিণা বৈরী (১৯৮৭)
১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় শ্রেষ্ঠ কবিতা।
তাঁর কবিতায় ঈশ্বর নেই—ঈশ্বরী আছেন। তিনি কবিতা সৃষ্টিকে তুলনা করেছেন নারীর গর্ভসঞ্চারের সঙ্গে।
নারীর শরীর, ভালোবাসা, বঞ্চনা, যৌনতা—সবকিছুকে তিনি সমাজ-বাস্তবতার কঠিন আলোয় তুলে ধরেছেন।
উপন্যাস
তিনি নারীর স্বাধীনতা, যৌনতা, ক্রোধ, প্রতিরোধ, সমাজের বাড়াবাড়ি প্রত্যাশা—সব কিছুই তাঁর উপন্যাসে নিখুঁতভাবে তুলে ধরেছেন।
গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস—
গল্পগ্রন্থ
গল্পগ্রন্থ দুটি। শ্রেষ্ঠগল্প (১৯৮৪) ও ৫০টি প্রিয় গল্প (১৯৮৮)।
২০১৩ সালে প্রকাশিত হয়েছে পঞ্চাশটি গল্প ও শ্রেষ্ঠ গল্প।
প্রমিতী ভৌমিক বলেন—
“একুশ শতকে দাঁড়িয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন তাঁকে। এ ধরনের প্রত্যয়ী কণ্ঠস্বর বাংলা সাহিত্যে অত্যন্ত দুর্লভ।”
আকাশবাণীর সময়
আকাশবাণীতে সাহিত্য আসর পরিচালনার সময় শেখর বসু গল্প পাঠ করতে যান। তাঁর অভিজ্ঞতায় বোঝা যায়—সেই সময় বেতার গণমাধ্যম কত বড় ভূমিকা পালন করত।
রেকর্ডিংয়ের সময় কবিতা সিংহ তাঁর লেখা পাতা স্টেপল থেকে খুলে প্রতিটি পাতার কোণা ভাঁজ করে দেন— যাতে উল্টানোর শব্দ না ওঠে।
কাজের প্রতি তাঁর নিষ্ঠা, শৃঙ্খলা, মনোযোগ ছিল অনন্য।
শেখর বসুর প্রথম রেকর্ডিং সফল হলে কবিতা সিংহ হাসিমুখে প্রশংসা করেন—এভাবেই তিনি নবীনদের হাতে ধরে কাজ শেখাতেন।
১৯৯৮ সালে বোস্টনে মেয়ের বাড়িতে তাঁর মৃত্যু হয়।
*****
লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী
আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।
ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com
লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।
ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।