উত্তরবঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলন-ডঃ সমিত ঘোষ || পঞ্চম পর্ব || প্রবন্ধ || অকপট অনুসন্ধান

0


চতুর্থ পর্বের পর... 
বালুরঘাটের কালী কিষেন সান্যাল, সুধাংশু মোহন চৌধুরী( চেরু), ধীরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, নৃপতি ভূষণ চট্টোপাধ্যায় এরা উত্তরবঙ্গের অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পরে এরা বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী দলে যোগদান করেন। বালুরঘাটে ফৌজি ফৌজদারি কোর্ট প্রাঙ্গণে অনিল বিশ্বাস ও অবিনাশ বসুর নেতৃত্বে এক সত্যাগ্রহী গণআন্দোলন শুরু হয় এর ফলে ব্রিটিশ সরকার বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।



Gandhiji Non-Cooperation Movement, Image Source: Wikipedia


সুভাষচন্দ্র বালুরঘাটের কংগ্রেস ভবনের দ্বারোদঘাটন করে যান এবং রাতে তিনি বালুরঘাটের চ্যাটার্জী বাড়িতে রাত কাটান। চ্যাটার্জি বাড়ির সদস্য সুশীল রঞ্জন চ্যাটার্জী,  সুরেশ রঞ্জন চ্যাটার্জী ও সরোজ রঞ্জন চ্যাটার্জী জেলার স্বাধীনতা আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছিল। চ্যাটার্জি বাড়ি আজও উত্তরবঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলনের নানা স্মৃতি বহন করে চলেছে।


Subhas Chandra Bose Image Sourse: Internet

১৯২১ সালে যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় তাতে বালুরঘাটের সমজিয়া  ও মহেশপুরে মাদকদ্রব্যের দোকানে পিকেটিং করার জন্য প্রিয়নাথ দাশ গ্রেপ্তার হন। ইটাহার,  কুশমন্ডি,  বংশীহারী সমস্ত থানাতেই অসহযোগ আন্দোলন দানা বাঁধে।
নিশীথনাথ কুন্ডু ১৯২১ সালে সাময়িকভাবে ওকালতি ছেড়ে ইটাহার,  কালিয়াগঞ্জ, রায়গঞ্জ এর বিভিন্ন গ্রামে গ্রামে ব্রিটিশ বিরোধী জনমত সংগ্রহের কাজে নেমে পড়ে। সুরেশ রঞ্জন চ্যাটার্জী,  রাজলক্ষী গুহ,  অনিল বিশ্বাস,  আব্দুর রহমান প্রমুখরা  দিনাজপুরের স্বাধীনতা আন্দোলনের মাটিকে পোক্ত করে তোলেন। ১৯২৫-এ যোগেন্দ্র চন্দ্র চক্রবর্তীর সভাপতিত্বে বালুরঘাটে জেলা সম্মেলন হয়। ওই সম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি আমির উদ্দিন চৌধুরী, সুরেশ রঞ্জন চ্যাটার্জী অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনের জন্য দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করেন। ১৯৩০-৩২ সালে আইন অমান্য আন্দোলনে বালুরঘাট মহকুমার অধিবাসীরা ব্রিটিশ বিরোধিতায় সামিল হয়। তাদের সমস্ত ক্ষোভ উগরে দেয়। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ বিরোধিতা করে বালুরঘাটে গ্রেপ্তার হন নৃপতি  চ্যাটার্জী। রমা সমাজদার,  জব্বার আলী,  রসিকলাল গুহ,  মহারাজা বোস,  জব্বার মিয়া প্রমুখরা।

Sushil Ranjan(L), Saroj Ranjan (M), Suresh Ranjan Chatterjee (R) Image Source: Writer

গঙ্গারামপুরে আকচা গ্রামের মানুষজন সরকারি ট্যাক্স  বন্ধ আন্দোলন শুরু করে। পুলিশ গোলাগুলি শুরু করলে কিছু আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ নিহত হন। আইন অমান্য আন্দোলনে পোরশা  থানার সুরেন্দ্র  বালা রায়,  বালুরঘাটের প্রভাবতী চ্যাটার্জী, কুমুদ কামিনী দেবী,  সুমতি হালদার প্রমুখরা বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। কমলেন্দু চক্রবর্তী পিকেটিং করে গ্রেফতার হন।

নয়াবাজার,  গঙ্গারামপুর,  ফুলবাড়ীতে দফায় দফায় পিকেটিং চলে।গঙ্গারামপুর থেকে আন্দোলনে যোগ দেন আশারাম মুদ্রা ও মোহিনী সাহা।১৯৩২- এর মধ্যে অনেকেই জেলে বন্দী হন। এরই মধ্যে কংগ্রেসের সম্মেলন হয়।এদিকে১৪৪ ধারা জারি। দিনাজপুরের ফুটবল মাঠে কমলেন্দু চক্রবর্তী ও সন্তোষ চ্যাটার্জীর নেতৃত্বে সম্মেলন হয়। রাজলক্ষ্মী গুহ সভানেত্রী মনোনীত হন। এই সম্মেলনের খবর পুলিশ জেনে যায়। বিরাট ফোর্স নিয়ে পুলিশ উপস্থিতও  হয় কিন্তু তার আগেই সকলে পালিয়ে যায়। ১৯৩৯- এ উত্তরের বিভিন্ন হাটে তোলা আদায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়।হরিরামপুর,  ফুলবাড়ি,  পতিরাম,  বাহিন, পতিরাজ হাটে তোলা আদায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয়।


Quit India Movement 1942 Swarak, Balurghat, Image Source: Writer

১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো বা আগস্ট আন্দোলনে সমগ্র দেশের সঙ্গে উত্তরবঙ্গও  উত্তাল হয়ে ওঠে।উত্তরবঙ্গ জুড়ে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জেঁকে বসে।মালদার ইংরেজবাজারে ৪২-এর আন্দোলন অগ্নিগর্ভ রূপনেয়। 'বন্দেমাতরম','ইংরেজ ভারত ছাড়ো' ধ্বনিতে উত্তরবঙ্গের আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হতে থাকে।৪২-এর আন্দোলন মালদার অবিসংবাদী নেতারা  হলেন- দিগিন্দ্র নারায়ন ভট্টাচার্য,  সুবোধ কুমার মিত্র প্রমুখেরা।কোচবিহারের৪২-এর আন্দোলনের ছোঁয়া লাগে।সেসময় কোচবিহারের মহারাজা ছিলেন জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ন।কোচবিহারে আগস্ট আন্দোলনের সমর্থনে সভা করেন প্রফুল্ল ত্রিপাঠী, কেশব চন্দ্র দত্ত, অনিল চক্রবর্তী প্রমুখরা।সভায় ব্রিটিশ বিরোধী বক্তব্য রাখার জন্য কেশবচন্দ্র দত্ত ও অনিল চক্রবর্তীর তিন মাসের জেল হয়েছিল।


"Quit India Movement 1942" Image Source: Wikipedia

১৯৪৬ সালে কোচবিহারে গঠিত হয় 'Civil liberties committee' এই কমিটির সম্পাদক ছিলেন ভিক্টোরিয়া কলেজের তরুণ অধ্যাপক দুর্গা কিংকর ভট্টাচার্য।এর সঙ্গে গঠিত হয়েছিল Cooch Behar Employees Association' এ ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন কোচবিহারের প্রথম গড়ে ওঠে।কোচবিহারে রাজনৈতিক দল গঠন নিষিদ্ধ হলেও কমিউনিস্ট পার্টি অনেক আগেই তাদের গোপন আস্তানা গড়ে তুলেছিল।কোচবিহারে ফরওয়ার্ড ব্লক গড়ে ওঠে ৪০- এর দশকে।এই দলের প্রাণপুরুষ ছিলেন নরেশ চন্দ্র বসু। জাতীয় কংগ্রেস তাদের শাখা খোলে স্বাধীনতার পর।

জলপাইগুড়িতেও ভারত ছাড়ো আন্দোলন শুরু হয়।আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন সুবোধ কুমার মিশ্র,  চারুচন্দ্র সান্যাল, শশধর কর,সতীশ চন্দ্র লাহিড়ী প্রমুখেরা।অবরোধ, মিটিং-মিছিল চলতে থাকে। শহর ও মফ:স্বলের  সব স্কুল বন্ধ হয়ে যায়।গ্রাম-শহরের মানুষ বুকের রক্তে শপথ নিলেন 'ইংরেজ হটাও'।৯ ই আগস্টের বিশাল মিছিলের পুরোভাগে পতাকা হাতে তারা ব্যানার্জি, উমা দাসগুপ্ত,  জগন্নাথ বাগচী, অমলেশ সান্যাল,  দেবব্রত মজুমদার,  বিধান সিংহ,  রথীন রায়,  অনিল গুহ,নিয়োগী, কুমার কৃষ্ণ ব্যানার্জি প্রমুখরা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম সারিতে ছিল।

চল্লিশের দশকে জলপাইগুড়িতে হিন্দু মহাসভা গঠিত হয়।এই মহা সভার সভাপতি ছিলেন কুমুদিনী কান্ত চক্রবর্তী।মুসলিম লীগের একটা জোর ছিল।এদের পারস্পরিক বিভেদ জেলার স্বাধীনতা আন্দোলনকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল।আলিপুরদুয়ার,  কুমারগ্রাম ও ফালাকাটাতে আগস্ট আন্দোলন দ্রুত বিস্তার লাভ করে।কুমার গ্রামের পোয়াতু  রায় ও চা বাগানের শ্রমিক সুখা ওরাও, দুখনা  গোয়ালা। খেতু মুন্ডা প্রমুখরা ব্রিটিশ শাসনের প্রতিবাদ জানায় কুমার গ্রামের ভারত ছাড়ো আন্দোলন বিখ্যাত ' তাঁর  কাটা' আন্দোলন হিসেবেই  পরিচিত। ফালাকাটায় সতীশ পাকড়াশী ৪২- এর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।


Swadhinatar Samay Balurghat er Chobi, Image Source: Writer

দিনাজপুরেও আগস্ট আন্দোলনে এক অদ্ভুত উন্মাদনা লক্ষ্য করা যায়।রায়গঞ্জ ও বালুরঘাটে ৪২- এর আন্দোলন দ্রুত প্রসার লাভ করে। রায়গঞ্জে ৪২- এর আন্দোলন তীব্র রূপ নেয়। শুরু হয় পিকেটিং। রায়গঞ্জের বহু বাড়িতে চরকায় সুতো কাটা হত।সরোজিনী গুহ,  সুহাসিনী গোস্বামী, বিমলা সুধা সিদ্ধান্ত প্রমুখের নেতৃত্বে রায়গঞ্জের বড়বাসা তে তাঁত বসানো হয়। বেশকিছু মহিলা সেই তাতে কাপড় বুনে স্বদেশীদের দান করতেন, নিজেও পড়তেন। ১৯৪২ সালে আগস্ট আন্দোলনে সুকুমার গুহ,  রবীন্দ্রনাথ ভৌমিক,  দীনেশ চন্দ্র দাস প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অংশ নিয়ে কারাবরণ করেন।  

বালুরঘাটের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি উল্লেখযোগ্য নাম হল ধীরেন ব্যানার্জি। ১৯৪২- এর আগস্ট বিপ্লবের  আগেই১৯৪১-এর নভেম্বর-এ DIR-এ গ্রেফতার হন। দিনাজপুর, হিজলি  ঢাকা ও Buxa  Detention Camp এ বন্দী জীবনযাপন করেন। ১৯৬৬ এর ১৪ই সেপ্টেম্বর সরোজ চ্যাটার্জীর নেতৃত্বে বিশ্বরঞ্জন সেন, পুলিন দাসগুপ্ত, রাধামোহন মহন্ত প্রমূখ বিপ্লবীদের নেতৃত্বে প্রায় ১২ হাজার জনতার এক বিরাট মিছিল বালুরঘাট ট্রেজারিতে জমায়েত হয়।আন্দোলনকারীরা ব্রিটিশ পতাকা নামিয়ে ত্রিবর্ণরঞ্জিত ভারতীয় জাতীয় পতাকা উড়িয়ে স্বাধীন ভারতের স্লোগান দিতে থাকে।বালুরঘাট তিন দিনেরও  বেশি স্বাধীন ছিল।সেই সময় ইংরেজ শাসনের কোনো অস্তিত্ব বালুরঘাটে ছিল না।৪২ এর আন্দোলনে দিনাজপুরের মানুষের আত্মত্যাগ চিরস্মরণীয়।

চলবে... 


লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী

আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।

ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com

লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।

ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন (0)
To Top