পঞ্চম পর্বের পর...
উত্তরবঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলনের মহিলারাও পিছিয়ে ছিল না। জলপাইগুড়িতে তারা বন্দোপাধ্যায়,বিভা দত্ত,লীলা সেন, কল্পনা নিয়োগী, উমা দাসগুপ্ত প্রমুখরা স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করে। জলপাইগুড়ি শহরের মহিলাদের একটি অংশ বিপ্লববাদের কাজে জড়িয়ে পড়েছিলেন।মহেন্দ্র বালা দেবী, বিনা চৌধুরী, সরয়ূ সরকার, বিনা ভৌমিক,উমা দাশগুপ্ত প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।নেতৃত্বে ছিলেন সুভাষিনী ঘোষ। সেদিনের স্বাধীনতা প্রিয় যুবকদের কাছে সুভাষিনী ঘোষের নেতৃত্ব ও তার মাতৃস্নেহ ছিল পরম আশ্রয়।দার্জিলিংয়ে বিপ্লবী বীণা দাশগুপ্ত তদানীন্তন ভাইসরয়কে গুলি করে হত্যার চেষ্টা করেন।তার সেই দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা সকলকে অবাক করে দেয়। কোচবিহারে অপরাজিতা গোপ্পীর নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল ঐতিহাসিক ছাত্রী ধর্মঘট।
ইলা মিত্র, চিত্রঃ লেখক
অবিভক্ত মালদহে নেত্রী ইলা মিত্রের অবদান আজও চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাটের ভারত ছাড়ো আন্দোলনে মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল দেখার মতো, বালুরঘাটের কুমুদকামিনী বন্দ্যোপাধ্যায়, রাজলক্ষ্মী গুহ, প্রভা চট্টোপাধ্যায়, বেলা রানী চট্টোপাধ্যায়(মাইজি), অমিয়া বসু, চকভবানীর লতিকা শিকদার প্রমুখরা মহিলা সমিতির সদস্য ছিলেন। ১৯৪০-এর দশকে বালুরঘাটে মহিলা সমিতি যথেষ্ট সক্রিয় ছিল।কংগ্রেস অফিসের একটি ঘরে তারা মহিলা সমিতির অফিস চালাত।মহিলা সমিতির আড়ালে পুলিশকে ধোকা দিয়ে এরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। যশোধা রানী সরকার ও কৌশল্যা কামড়ানি তেভাগা আন্দোলনে সক্রিয় অংশ নিয়ে কয়েকমুঠো ধানের জন্য পুলিশ ও জমিদারের যৌথ আক্রমণে নিহত হন।
বেলা রানী চট্টোপাধ্যায়(মাইজি), চিত্রঃ লেখক
উত্তরবঙ্গের মানুষ জাতি,ধর্ম নির্বিশেষে এভাবেই পরাধীন ভারতে ব্রিটিশ বিরোধিতা করেছিল। কংগ্রেসী থেকে কমিউনিস্ট,প্রথম সারির নেতা থেকে সাধারণ মানুষ সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ স্বাধীনতার নেশায় মেতে ওঠে।কত তরুণ-তরুণীর তাজা রক্তে যে সেদিন উত্তরবঙ্গের মাটি ভিজেছিল,তার ইয়ত্তা নেই। সেজন্যই উত্তরবঙ্গের মানুষের আত্মত্যাগ ও আত্ম বলিদান আজও ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে।১৯৪৭ সালের ১৫ ই আগস্ট ভারত স্বাধীন হল কিন্তু র্যাডক্লিফ প্রস্তাব অনুসারে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলি টুকরো টুকরো হয়ে যায়।এতে দেখা গেলো উত্তরবঙ্গ পড়লো দিনাজপুর, মালদহ, জলপাইগুড়ির ১০ টি থানা এবং সমগ্র দার্জিলিং জেলা, অর্থাৎ রাজশাহী বিভাগের এক তৃতীয়াংশ গেল বর্তমান উত্তরবঙ্গের মধ্যে। র্যাডক্লিফ ঘোষণায় পশ্চিমবঙ্গের তিনটি ভাগ হলো-(ক) দক্ষিণবঙ্গ (খ ) মালদহ, পশ্চিম দিনাজপুর বা গৌড়বঙ্গ (গ ) জলপাইগুড়ি,দার্জিলিং এবং দেশীয় রাজ্য কোচবিহার।১৯৪৭ সালে জলপাইগুড়িতে লক্ষীকান্ত মৈত্রর সভাপতিত্বে 'উত্তরবঙ্গ সম্মেলন' আয়োজিত হয়।সমস্ত উত্তরবঙ্গের প্রতিনিধিরা সেদিন সভায় উপস্থিত হয়ে উত্তরবঙ্গের লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করেছিল।
উত্তরবঙ্গের মানচিত্র, চিত্রঃ উইকিপিডিয়া
উত্তরবঙ্গের এমন খন্ডিত রূপে সেদিন অনেকেই ব্যথিত ছিলেন কিন্তু অনেকে নিশ্চুপ ছিলেন।স্বাধীনতার পর অনেক ভাঙ্গাভাঙ্গি হয়েছে শেষে আত্মপ্রকাশ করেছে আজকের উত্তরবঙ্গ।সেদিনের অবহেলিত উত্তরবঙ্গ আজও সেই গ্লানি বহন করে চলেছে।সময়ই হয়তো সেই গ্লানি মুছে উত্তরবঙ্গের মুখে সংস্কারের হাসি ফোটাবে যা উত্তরবঙ্গের আপামর মানুষের জীবনে খুশির হাওয়া বহন করে আনবে।কবির ভাষায় বলি -
" বাঁচবো রে বাঁচবো
ভাঙা বুকের পাঁজর দিয়া
নয়া বাংলা গড়বো।"- হেমাঙ্গ বিশ্বাস
তথ্যসূত্রঃ ১। আগুন প্রথম জ্বলে উঠেছিল সন্ন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহে, সমিত ঘোষ, বর্তমান, ২১.০৮.২০০৭
২। মধুপর্ণী বিশেষ জলপাইগুড়ি জেলা সংখ্যা, ১৯৮৭, (পৃ:২৬৭)
৩। মধুপর্ণী বিশেষ কোচবিহার জেলা সংখ্যা, ১৯৯০, (পৃ:৩৯৭)
৪। আর্থ- সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গে দক্ষিণ দিনাজপুর, সমিত ঘোষ, ৯/৩ টেমার লেন, পত্রলেখা প্রকাশন, কলকাতা-৯, (পৃ:৩)
৫। বিপ্লবী দিন লিপি, ভবেশ চন্দ্র বন্দোপাধ্যায়, গাঙচিল, ৩৩ কলেজ রো, কলকাতা-৯(পৃ:১৮২)
৬। মধুপর্ণী বিশেষ দার্জিলিং জেলা সংখ্যা, ১৯৯৬, (পৃ:৯৪)
৭। পশ্চিমবঙ্গ পত্রিকা, জলপাইগুড়ি জেলা সংখ্যা, জলপাইগুড়ি জেলার স্বাধীনতা আন্দোলন, মুকুলেশ সান্যাল, (পৃ-৮৮)
৮। ৬। এর অনুরূপ, (পৃ:৯৬)
৯। বিবিধ প্রসঙ্গে গ্রামীণ রায়গঞ্জ, (পৃ:১৪২-১৫২)
১০। স্বাধীনতা সংগ্রামী পার্বতী চরণ ধরের কথা, ডঃ বৃন্দাবন ঘোষ, (পৃ: ৯-২২)
১১। ৫। এর অনুরূপ, (পৃ:৪০৮)
১২।উত্তরবঙ্গের ইতিহাস ও পুরাকীর্তি, ডঃ সমিত ঘোষ, অমর ভারতী, ৮সি টামার লেন, কলকাতা, (পৃ:২৮৭-২৮৮)
লেখা পাঠানোর নিয়মাবলী
আপনারা আপনাদের মূল্যবান লেখা নির্দ্বিধায় আমাদের কাছে পাঠাতে পারেন। আমরা তা আমাদের অনলাইন ম্যাগাজিনে প্রকাশ করব।
ইমেল আইডি: contact.okopotanusandhan@gmail.com
লেখার ফরম্যাট: অভ্র ইউনিফাইড টাইপ কিপ্যাডে টাইপ করে লেখা পাঠাতে হবে।
ইমেলে যা উল্লেখ করবেন: আপনার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি এবং কোন ক্যাটাগরিতে লিখছেন তা উল্লেখ করতে ভুলবেন না।





